শনিবার, ৪ জুন, ২০১১

মহাবীরের দিগম্বর মতবাদ

জৈন ধর্মের দু'টি ভাগ। একটি শ্বেতাম্বর, দ্বিতীয়টি দিগম্বর। জৈন মত অনুসারে চব্বিশজন তীর্থংকর জৈন ধর্মের বিকাশ ঘটিয়েছিল। প্রথম তীর্থংকরের নাম ঋষভ বা আদিনাথ। পরবর্তী তীর্থংকররা হলেন : অর্জিত, সম্ভব, অভিনন্দ, সুমতি, পদ্মপ্রভ, সুপার্শ্ব, চন্দ্রপ্রভ, সুবিধি,শীতল, শ্রেয়াংশ, বসুপুজ্য, বিমল, অনন্ত, ধর্ম, শান্তি, কুন্‌থ, আর, মল্লি, মুনিসুব্রত, নমি, অরিষ্টনেমি, পার্শ্ব বা পার্শ্বনাথ অথবা পরেশনাথ ও মহাবীর। মহাবীর হলেন চব্বিশতম তীর্থংকর।



এক থেকে বাইশতম তীর্থংকরকে নিয়ে এত বেশি অতিরঞ্জন ও অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি যে, ঐতিহাসিকদের ধারণা এ'গুলো কল্পকাহিনী। এতে এমনটা হতে মনে হতেই পারে যে, এইসব তীর্থংকরদের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ভক্তির প্রাবল্যে এদের চরিত্রগুলোকে ভক্তরা বেশি রকম বড় করতে গিয়ে অবাস্তব করে তুলেছেন।



তীর্থংকর হিসেবে পার্শ্ব বা পার্শ্বনাথই প্রথম, যার অস্তিত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। জৈন মত অনুসারে পার্শ্বনাথের জন্মও আনুমানিক ৮১৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। পিতা অশ্বসেন ছিলেন গোষ্ঠীপতি। এক গোষ্ঠীপতির কন্যার সঙ্গে পার্শ্বনাথের বিয়ে হয়।



মানুষের জীবনের নানা দুঃখ দেখে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে তিরিশ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন। এদিক থেকে পার্শ্বনাথের সঙ্গে বুদ্ধের কিছু মিল আমরা পাই। পার্শ্বনাথের দুঃখ চেতনা ছিল জাগতিক, বুদ্ধের মত।



সত্যকে জানতে, দুঃখের কারণ জানতে তিরিশ দিন ধরে নিজেকে সমাজ-সংসার থেকে দূরে রেখে গভীর চিন্তায় ডুবিয়ে রাখেন। শেষে দুঃখের কারণ ও তার থেকে অব্যাহতির উপায় খুঁজে পান। সত্তর বছর ধরে তার মতাদর্শ প্রচার করেন। একশো বছর বয়সে মৃত্যু।




পার্শ্বনাথের চার নীতি বা চতুর্যাম

পার্শ্বনাথ তার প্রচারিত ধর্মে 'চতুর্যাম' অর্থাৎ চারটি নীতি বা ব্রতর কথা বলেছিলেন।

১. অহিংসা - কারও জীবননাশ করবে না।

২. অনৃত - মিথ্যে বলবে না। কারও বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ আনবে না।

৩. অস্তেয় - চুরি করবে না। চোরদের কাছ থেকে কোন জিনিস কিনবে না। ক্রেতাকে মিথ্যে ওজনে জিনিস বিক্রি করবে না। দ্রব্যে ভেজাল দেবে না।

৪. অপরিগ্রহ - ব্যক্তিগত জমিজমা - ভূসম্পত্তির অধিকারি হবে না।




মহাবীর

চব্বিশতম তীর্থংকর মহাবীর জৈনদের দিগম্বর সম্প্রদায়ের স্রষ্টা। নগ্নতাবাদী মহাবীরের জন্মও আনুমানিক ৫৯৯ বা ৫৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। জন্মও বৈশালীর বসুকুণ্ড গ্রামে ( বর্তমান মজঃফরপুর, বিহার ।). পিতা সিদ্ধার্থ ছিলেন একটি উপজাতির গোষ্ঠীপতি। জৈন শ্বেতাম্বরপন্থীদের মতে মহাবীরের একটিই মেয়ে - অনুজা।

দিগম্বর থেকে মহাবির ছিলেন চিরকুমার ও কঠোর ব্রহ্মচারী। তিরিশ বছর বয়সে তার বিপুল সম্পত্তি দান করে দিয়ে গ্রিহত্যাগ করেন ও পরিব্রাজক বৃত্তি গ্রহণ করেন। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে চেয়েছিলেন দুঃখের কারণ ও দুঃখময় জগৎ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে।



পরিব্রাজক জীবনে তিনি কোন গ্রামে এক রাতের বেশি থাকতেন না। এভাবে তের মাস কেটে যাওয়ার পর কাপড় পরিধান করা ছেড়ে দেন। মহাবীর দিগম্বর থাকার কারণে নানা জায়গায় খারাপ ব্যবহার পেয়েছেন।



পরিব্রাজক জীবনের তৃতীয় বছরে তিনি আর এক চিন্তাবিদ গোশাল মংখলিপুত্তের সঙ্গে পরিচিত হন। দুজনে মত বিনিময় ও চিন্তা বিনিময়ের মধ্যে ছয় বছর কাটিয়ে দেন। তারপর মত পার্থক্যের কারনে দুজনের বিচ্ছেদ হয়। গোশাল নিজেকে তীর্থংকর ঘোষণা করেন এবং তীর্থংকর মহাবীরকে ত্যাগ করেন।



দীর্ঘ বার বছরের পরিব্রাজক জীবনে তিনি মগ্ন হয়ে শীত-গ্রীষ্মের তাপের কষ্ট পেয়েছেন। নগ্নতার কারনে ভিক্ষেও জোটেনি। দীর্ঘ দিন কেটেছে অনশনে, মানুষের ও কুকুরের তারা খেয়ে। শরীরকে এমনভাবে কষ্ট দেয়ার কারণ, মহাবীর এই সময় মনে করতেন দুঃখভোগই পাপস্খালন এবং মুক্তির উপায়।



ঋজুপালিকা নদীর তিরে জৃনভিকা গ্রামে একটা শালগাছের নিচে বসে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উপলব্ধিতে পৌঁছন বা জ্ঞান লাভ করেন। এরপর ধর্ম প্রচারে বের হন। মহাবীরের মামা বৃজি উপজাতির গোষ্ঠীর প্রধান চেটক ছিলেন মহাবীরের পৃষ্ঠপোষক। অজাতশত্রু মগধরাজ থেকে কৌশাম্বীর রাজা স্থানক মহাবীরকে সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানান।



জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে উপদেশ প্রচার করে বেরিয়েছিলেন। ৮৪ বছর বয়সে তিনি পাবা'য় (বর্তমান গরক্ষপুর) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মহাবীর ছিলেন বুদ্ধের সমসাময়িক। ছিলেন অত্যন্ত ভাল সংগঠক। জৈন সংঘকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।



মহাবীর বৈদিক যুগের সমসাময়িক ছিলেন। বেদকে অভ্রান্ত মনে করতেন না। তিনি ছিলেন নিরীশ্বরবাদী নাস্তিক, অলৌকিকে অবিশ্বাসী, নিয়তিবাদে অবিশ্বাসী। আপেক্ষিক গুণবাদ বা 'স্যাদ্‌বাদ'-এ বিশ্বাসী ছিলেন।




পঞ্চব্রত

মহাবীর চতুর্যামের পরিবর্তে 'পঞ্চব্রত' বা পাঁচটি নীতির কথা বলেছিলেন। পার্শ্বনাথের নিতগুলো সরিয়ে তিনি নতুন কিছু নীতির প্রবর্তন করেন নি। চতুর্যামের চারটি নীতির সঙ্গে একটি নতুন নীতি যুক্ত করেছিলেন। নীতিটি হল ব্রহ্মচর্য। 'ব্রহ্মচর্য' বলতে শুধু সহবাস থেকে বিরত থাকা বোঝায় না, সমস্ত ইন্দ্রিয়ভোগ থেকে বিরত থাকা বোঝায়।

এই পঞ্চব্রতকে আবার মহাবীর দু'ভাগে ভাগ করেছিলেন। ১. অনুব্রত ও ২. মহাব্রত। গৃহী জৈনদের জন্য নরম করে তৈরি হয়েছিল অনুব্রত । গৃহীদের পক্ষে 'অহিংসা' বলতে বলা হয়েছে- উদ্ভিদজাতীয় প্রাণির উর্ধ্বতন যেসব প্রাণী, তাদে৪র প্রতি অহিংসা ব্রত পালন করতে হবে। 'ব্রহ্মচর্য' বলতে বলেছেন, গৃহীদের একপত্নী ব্রত পালনের কথা।

শ্রমণদের বেলায় 'ব্রহ্মচর্য' আবশ্যিক শর্ত। দিগম্বরপন্থীরা মনে করেন শ্রমণ বা জৈন সন্ন্যাসীদের অবশ্যই সমস্ত পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে হবে, নগ্ন থাকতে হবে। দিগম্বরপন্থীরাও আরও মনে করেন, তীর্থংকররা প্রত্যেকেই পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েই জ্ঞানের সাধনা করেছিলেন। জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সুতরাং তীর্থংকরদের ছবি আঁকতে হলে নগ্নই আঁকতে হবে, মূর্তি-খোদিত হলে, তা হবে নগ্ন। কাপড় পরিয়ে সভ্য সাজাবার প্রয়াস মিথ্যাকে সত্যি বলে প্রচার ছাড়া কিছু নয়। এই ধরণের মিথ্যাচারিতা 'অনৃত' বা সত্য নীতিকে লঙ্ঘন করা।



জৈন দার্শনিকদের মধ্যে পরমাণু সম্পর্কে ধারণা ছিল। উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জয়োতির্বিদ্যার উন্নতির ক্ষেত্রে জৈন দার্শনিকদের অবদান অনস্বীকার্য।

জৈন ধর্মের প্রধান সংগঠক চিলেন দিগম্বরবাদী মহাবীর। তাই বৈদিক যুগের পুরোহিত সম্প্রদায়ের তীব্র ক্ষোভ দিগম্বরদের উপর ছিল। ঈশ্বর নেই, মানে ঈশ্বর উপাসনা, যাগ-যজ্ঞ, হোম, বলি, পুরোহিতদের প্রণামী দেয়া সবই অর্থহীন। এতো দস্তুরমতো বৈদিক পুরোহিতদের অস্তিত্বের সংকট! এই সংকট কাটাতে পুরোহিতরা নিরীশ্বরবাদীদের উপর খড়্গহস্ত ছিলেন। এমনকী নিরীশ্বরবাদীদের ঝাড়ে-বংশে নির্মূল করতে আক্ষরিক অর্থেই অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন হাতে।




দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর বিরোধ

জৈন ধর্ম প্রধানত নীতি-ধর্ম। জৈন ধর্ম মহাবীরের সময় দুটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়। ১. দিগম্বর ও ২. শ্বেতাম্বর। দিগম্বররা শরীরে কোন কাপড় রাখেন না। তারা নগ্নতাবাদী ও প্রকৃতিবাদী। শ্বেতাম্বররা সাদা কাপড় পরেন। শ্বেতাম্বররা মনে করেন জৈন ধর্মের পবারটি প্রাচীন 'অঙ্গ' গ্রন্থ আছে। এই বারটি অঙ্গ নামের গ্রন্থ ছাড়াও 'উপাঙ্গ' নামে আরো বারটি ধর্মগ্রন্থ আছে। অঙ্গ ও উপাঙ্গ ছাড়াও আরও কিছু গ্রন্থকে শ্বেতাম্বররা জৈন ধর্মের অন্তর্গত বলে মনে করেন।



দিগম্বরপন্থীরা মহাবীরের সময়ের আগে লেখা কোনও জৈন-গ্রন্থকেই প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে না। দিগম্বরপন্থীদের কিছু ধর্মীয় গ্রন্থ আছে যেগুলো চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত। সেসব গ্রন্থ মহাবীরের সময়ে ও পরবর্তীকালে লেখা।



পার্শ্বনাথের চতুর্যাম শ্বেতাম্বররা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেন। দিগম্বররা মানেন মহাবীরের পঞ্চব্রত। দিগম্বররা কিছুটা কট্টরপন্থী। তারা মনে করেন, ১. নারীরা মোক্ষ লাভের অধিকারী নয়। ২. চিত্রে বা মূর্তিতে তির্থংকরদের নগ্ন রাখতে হবে, চোখ থাকবে মুদ্রিত। ৩. জৈন শ্রমণ অর্থাৎ জৈন সাধুদের নগ্ন থাকতে হবে। ৪. প্রকৃত জ্ঞানীদের কোন খাদ্যগ্রহণের প্রয়োজন হয় না, যেমন হয়নি মহাবীরের। ৫. মহাবীরই শেষ প্রকৃতজ্ঞানী বা তীর্থংকর। ৬.সব শাস্ত্র ও ধর্মীয় গ্রন্থই মানুষের লেখা, তাই চিরন্তন বা শাশ্বত নয়। এই শেষ বক্তব্যের মধ্যে বেদকে অস্বীকার করা হয়েছে স্পষ্টভাবে।



জৈনদের এই দুটি ভাগ আবার পরবর্তীকালে আরও কিছু উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। শ্বেতাম্বররা তিনটি উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত- মূর্তিপূজক, তেরপন্থী ও স্থানকবাসী। উত্তরভারতে শ্বেতাম্বরদের প্রাধান্য রয়েছে। দিগম্বররা পাঁচটি উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত। এরা হল- বীসপন্থী, তেরপন্থী, তোতাপন্থী, তারণপন্থী এবং গুনামপন্থী। দক্ষিণভারতে এদেরই প্রাধান্য। ভারতে সামগ্রিকভাবে শ্বেতাম্বরপন্থীদের-ই স্পষ্ট প্রাধান্য রয়েছে।




স্যাদ্‌বাদ বা আপেক্ষিক গুণবাদ

জৈন্রাই প্রথম 'আপেক্ষিক গুণবাদ' বা স্যাদ্‌বাদের কথা বলল। এই মতবাদের মূল কথা- কেউ যখন কোন বস্তুর বর্ণনা দেয়, তখন সে তার ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে দেয়। বস্তুর এই বর্ণনা তখনকার মত সত্য হলেও নিত্য নয়। স্যাদবাদে ছয় অন্ধের হাতি দেখার কথা বলা হয়েছে। একই হাতি কারও কাছে দড়ির মতো, কারোর কাছে গুঁড়ির মতো, কারও কাছে বা সাপের মতো। এসবই আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ সত্য নয়।



ভোরের সূর্য ও গোধূলির সূর্য লাল টুকটুকে। দুপুরের সূর্য যখন মধ্য আকাশে, তখন সে আগুনের গোলা। এসবই সত্যি। সময়ের সঙ্গে সত্যিটা পালটে যায়, যাকে বলে আপেক্ষিক গুণ। আপেক্ষিক গুণ সংক্রান্ত মতবাদই স্যাদবাদ। যুক্তিবাদের একটি সিদ্ধান্ত আমরা দেখতে পাই স্যাদবাদে।




মোক্ষ

জৈন মাত্রেই নিরীশ্বরবাদী। জৈন ধর্মগ্রন্থের লেখকেরা ঈশ্বর ধারণাকে খণ্ডন করেছিলেন। জৈনরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না বটে, কিন্তু দেবতায় বিষ্বাস করে। জৈন ধর্মে দেবতা ও ঈশ্বরের সংজ্ঞায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। জৈনরা গুণের প্রতিককে 'দেবতা' বলে। দেবতার কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নেই। পার্থিব কোনও কিছু দেবার ক্ষমতা নেই। মানুষ সাধনার মধ্য দিয়ে দেবতা হতে পারে।



বৌদ্ধদের একাধিক সম্প্রদ্য মনে করে, যে কেউ সাধনার দ্বারা বৌদ্ধত্ব লাভ করতে পারে, বুদ্ধ হতে পারে। জৈনদের 'দেবতা' ধারনা অনেকটা এইরকম। তারা মনে করে, সাধনা ও জ্ঞানার্জনের ফল হিসেবে পরজন্মে মানুষ দেবতা হওয়া যায়। এই দেবতারা জন্ম-মৃত্যুর অধীন। দেবতা জন্মে খারাপ কাজ করলে পরজন্মে কীট হয়ে জন্মাতে হবে। অর্থাৎ জৈনরা পরজন্মে বিশ্বাসী।



দেবতা হওয়ার উপায় কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি। মুক্তির জন্য জরুরি ১. সম্যক জ্ঞান, ২. সম্যক দর্শন, ৩.সম্যক চরিত্র। দেবত্ব লাভ বা মোক্ষ লাভের এই তিন আবশিক শর্তকে বলে 'রত্নত্রয়'।



'সম্যক জ্ঞান' বলতে জৈন ধর্ম বিষয়ে বিস্তৃত জ্ঞান ও স্বচ্ছ বা স্পষ্ট জ্ঞানকে নির্দেশ করা হয়েছে।

'সম্যক দর্শন' অর্থে জৈন ধর্মের নীতিতে অবিচল থাকার কথা বলা হয়েছে।

'সম্যক চরিত্র' বলতে জৈন ধর্মের নীতি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে।




জৈন সংঘ

জৈন সংঘ ও বৌদ্ধ সংঘের আদর্শ মোটামুটি একই। আদিম উপজাতি সম্প্রদায়ের মত জৈন সংঘেও ব্যক্তিগত আপত্তি বলে কিছু ছিল না। শ্রমণদের সমস্ত রকমের জাগতিক ইন্দ্রিয়সুখকে বর্জন করতে হত। আহার ও শয্যা বিষয়ে কোন মতামত প্রকাশ ধর্মচ্যুতি হিসেবে গণ্য হত।



জৈন ধর্মের বিকাশ ভারতবর্ষের বাইরে কোথাও হয় নি। ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে জৈন ধর্মের মানুষেরা সংখ্যায় অনেক।




অণু-পরমাণু বা 'পুদ্‌গল'

জোইন দার্শনিকদের মধ্যে পরমাণু সম্পর্কে ধারণা ছিল। জৈন দার্শনিকরা বললেন, স্থুল জড়বস্তুকে ভাঙ্গা যায়। ভাঙতে ভাঙতে এমন একটা ক্ষুদ্রতম অংশে পৌঁছায়, যখন আর ভাঙ্গা সম্ভব নয়। জড়ের বা 'পুদ্‌গল' এর এই অবিভাজ্য সূক্ষ্ম কণাকে 'অণু' বলে। অণুই জড় জগতের মৌলিক উপাদান।



জৈন পরমাণুবাদের সঙ্গে ন্যায়বৈশেষিকদের পরমাণুবাদের গুণগত পার্থক্য আছে। ন্যায়বৈশেষিক মতে পরমাণুদের মধ্যে আবার গুণগত পার্থক্য আছে। জৈন মতে পরমাণুদের মধ্যে গুণগত কোন পার্থক্য নেই। প্রতিটি পরমাণু সমগুণদম্পন্ন। উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিতসা-বিজ্ঞান ও জ্যোটির্বিদ্যার উন্নতির ক্ষেত্রে জৈন দার্শনিকদের অবদান অনস্বীকার্য।




জৈন ও বণিক সম্প্রদায়

জৈন ধর্ম মূলত নীতিমূলক ধর্ম। এই ধর্মে অহিংসাকে বেশি রকম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অজ্ঞান্তসারে একটি পোকাকে হত্যা করলেও তা পাপ। জৈনদের অনেকেই এক টুকরা সাদা কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখে, যাতে কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী নাকে-মুখে ঢুকে মারা না যায়।



ভারতের বাইরে জৈন ধর্ম পা রাখতে না পারলেও ভারতের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে জৈন ধর্ম প্রসার লাভ করেছিল। এর পিছনেও কার্য-কারণ সম্পর্ক ছিল। জৈন ধর্ম অহিংসার উপর এত বেশি জোর দিয়েছিল যে, কৃষিজীবীদের পক্ষে এই ধর্ম গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। কারন চাষের সময় গাছে পোকা লাগলে তা না মেরে হাতগুটিয়ে বসে থাকলে নিজেদের মরতে হয়। গাছে পোকা লাগা ও পোকাদের মেরে ফসল বাঁচানো কৃষিরই অঙ্গ।



ব্যক্তিগত সম্পত্তি-জমিজমা কেনা জৈনধর্মে নিষিদ্ধ। জমজমা কিনে শ্রমজীবীদের দিয়ে চাষবাস করে আয়ের পথও ছিল বন্ধ। ফলে জৈন ধর্মে দীক্ষিতরা ব্যবসার দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিল। গুজরাট মহারাষ্ট্রের উপকূলে নৌ-বাণিজ্যের সুবিধা ছিল। জৈন ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ পণ্যদ্রব্য নিইয়ে জাহাজ ভাসিয়ে দিলেন। ব্যবসা যে ভালই চলছিল , সে খবর জানতে পারি বিভিন্ন শিলালিপি থেকে। এইসব শিলালিপিতে ব্যবসায়ীদের নানা দান-ধ্যানের খবর থাকতো।



সংঘগুলো ব্যাঙ্কের মত কাজও করতো। বণিকরা সংঘের মারফত সুদে টাকা ধার দিত। মহারাষ্ট্রের নাসিকে পাওয়া একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, সুদের টাকায় একটি সংঘের কাজ পরিচালিত হত। বিজ্ঞানের উন্নতির পাশাপাশি ব্যাবসার উন্নতির ক্ষেত্রেও জৈনদের অবদান স্বীকার করতেই হয়। জৈন ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে আমরা জানতে পারি যে, আদিতে জৈনরা বাস করতেন প্রধানত কোসল, বেদেহ, মগধ ও অঙ্গ অঞ্চলে। তারপর আমরা জানতে পাচ্ছি কলিঙ্গ দেশে জৈনদের ছড়িয়ে পড়ার কথা। সেখানকার রাজা খারবেল জৈনধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর আমলে খণ্ডগিরি ও কুমারী পর্বতে কয়েকটি জৈন গুহা তৈরি হয়েছিল। পাবা'ইয় গড়ে উঠেছিল একটি মঠ।



জৈন ধর্ম তারপর ছড়িয়ে পরে মথুরায়। এই সময়টা হল প্রথম ও দ্বিতীয় শতক। এরপর জৈনদের প্রভাব ছড়ায় মালব ও উজ্জয়িনীতে। গুপ্তযুগের বিভিন্ন পুরাতত্ব নিদর্শন থেকে জানা যায় যে সে সময় জৈন ধর্মের প্রভাব ছিল। পাহাড়পুর, তক্ষশীলা ও গুজরাটেও জৈন ধর্ম প্রভাব বিস্তার করে।



সপ্তম থেকে দশম শতকে জৈন ধর্মে দেখা দেয় ভাটার টান। শেষ পর্যন্ত জৈন ধর্ম টিকে রইল কিছু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে, যাদের সঙ্ঘভাগই গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশবাসী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন