শনিবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৭

সেক্সুয়াল অবিজেক্টিফিকেশন নিয়ে কিছু কথা

(একটা স্ট্যাটাসের কমেন্ট হিসেবে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন নিয়ে কিছু কথা লিখেছিলাম। সেটাই এখানে দিচ্ছি। যেহেতু স্ট্যাটাসের জবাবে লেখা তাই সব সেক্সুয়াল অনজেক্টিফিকেশন নিয়ে এই লেখা আংশিক, পূর্ণাঙ্গ নয়। এটা দুটো বিষয়কে সামনে রেখে লেখা হয়েছে, যথা - 'একই কাজ নারী করলে সে হয়ে যায় পণ্য, আর পুরুষ করলে সে হয়ে যায় অভিনেতা' এবং 'সমস্যা কি শুধুই উপস্থাপনে, নাকি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মগজে?'। শেষে এই সমস্যার সমাধান দেবার একটা চেষ্টা করা হয়েছে।)
পুরুষের সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন
সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন যে কেবলমাত্র নারীর সাথে হবারই বিষয়, আর যে কাজ নারী করলে পণ্য কিন্তু পুরুষ করলে পণ্য না হয়ে কেবল অভিনেতা - এই ধারণা সঠিক নয়। পুরুষরাও সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনের শিকার হয়।
বিষয়টি সম্ভবত সবার আগে ফেমিনিস্ট অথর নাওমি ওল্ফ আর ক্রিশ্চিনা হফ সমারস তুলে এনেছিলেন। তারা বলেন, উইমেন সেক্সুয়াললিবারেশন নারীদেরকে রোল রিভার্সালের দিকে নিয়ে যেতে পারে, আর এরপর তারা পুরুষকেও সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফাই করতে পারে, এক্ষেত্রে যেভাবে নারীদের অবজেক্টিফাই করার জন্য পুরুষকে সমালোচিত করা হয়, সেরকমই নারীদেরও সমালোচিত করা যায়। সাইকোলজিস্ট হ্যারল্ড লিয়ন বললেন নারীর মুক্তির জন্য পুরুষের মুক্তিও দরকার। গবেষণায় দেখা গেল, অবজেক্টিফিকেশন নারীদের মত পুরুষদেরকেও প্রভাবিত করে, তাদের মধ্যে নেগেটিভ বডি ইমেজ তৈরি করে। ওয়েস্টার্ন সোসাইটিতে সেক্সুয়াল রেভোল্যুশনের সাথে সাথে দেখা গেল বিভিন্ন এডভারটাইজমেন্ট, মিউজিক ভিডিও, টেলিভিশন শো, উইমেনস ম্যাগাজিন, মেলস স্ট্রিপ শো, CFNM ইভেন্ট ইত্যাদিতে পুরুষের অবজেক্টিফিকেশন দেখা যায়। নারীদেরকে পর্নোগ্রাফিও কিনতে দেখা যায়।
নারীর অবজেক্টিফিকেশনে সমাজের গেইজ পড়ে যাওয়ায়, পুরুষের অবজেক্টিফিকেশন চোখে পড়ে না। কিন্তু গবেষণায় উঠে আসে ৩৭ শতাংশ বিজ্ঞাপনেই পুরুষের অঙ্গকে প্রোডাক্ট হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আর সাইকোলজিকালি পুরুষদেরকেও এই অবজেক্টিফিকেশন বডি শেমিং, ইটিং ডিজর্ডার, পারফেকশন কামনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, ঠিক যেমনটা নারীদের বেলাতে হয়। দেখা যায় বডি ইভাল্যুশন এর বেলায় যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করা হচ্ছে সেটা অর্জন করতে গিয়ে এরা স্টেরয়েড গ্রহণ করছে, অনেকেই "আইডিয়াল ম্যান" হবার স্বপ্নে বিভোর। যাদের এই আইডিয়াল বডি শেপ নেই, তাদেরকে আমরা কমিক রিলিফ বলি, আর চাইনা যে এরা কোন টিভি শো বা মুভিতে লিডিং রোলে আসুক। এই ব্যাপারটা আমাদের মাইন্ডসেটকেই বদলে ফেলছে। তবে সেল্ফ অবজেক্টিফিকেশনের ব্যাপারটা নারীদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়, আর নারীরা যেভাবে নেতিবাচকভাবে ভুক্তভোগী হয়, পুরুষেরা সেই তুলনায় কম হয়।

সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন সম্পর্কিত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি
সমস্যাটা কোথায়? শুধুই উপস্থাপনে নাকি মগজে এটা নিয়ে ফেমিনিস্ট থিওরিতে অনেক আলোচনা হয়েছে, সেই সাথে এর সাথে সম্পর্কিত নৈতিক বিষয়গুলো নিয়েও। নাওমি ওল্ফ বলেছেন, ফিজিকাল এট্রাকটিভনেস জিনিসটাই আসলে সমস্যার। এট্রাকটিভনেস জিনিসটা থাকে বলেই, একটা বিশেষ ধরণ আমাদেরকে এট্রাক্ট করে বলেই আসলে এটা হয়ে থাকে। আমরা সকলেই আসলে এদিক থেকে বায়াজড, মানে সবার মগজেই সমস্যা। এদিকে রেডিকেল ফেমিনিস্টরা কোন ব্যক্তির ফিজিকাল ক্যারেকটারিস্টিকসের উপর যে তার সেক্সুয়াল এট্রাকটিভনেস নির্ভর করে তা মানতে নারাজ। তাদের মতে এগুলো আসলে মানুষের চয়েস। কেউ চাইলে নিজেকে এভাবে তৈরি করে উপস্থাপন করতে পারে যা অবজেক্টিফিকেশনকে ত্বরান্বিত করে। তাদের মতে এই সমস্যাটা মগজে ময়, উপস্থাপনে।
রেডিকেল ফেমিনিজম অনুসারে নারীদেরকে অপ্রেসড সেক্স ক্লাস বানানোর মূলে হচ্ছে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন। অনেক রেডিকেল ফেমিনিস্ট ভাবেন, আমাদের মিডিয়া পুরুষতান্ত্রিক বলে তা অবজেক্টিফাই করে, পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে তারা পুরুষদেরকে নারীদের অবজেক্টিফাই করতে হ্যাবিচুয়েট করে।
কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীলরা এই অবজেক্টিফিকেশন নিয়ে ফেমিনিস্ট ক্রিটিককে নিজেদের সুবিধায় ব্যবহার করে। তারা যেহেতু সেক্সুয়াল রেভোল্যুশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাই তারা বলে এই সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন হচ্ছে ওয়েস্টার্ন সোসাইটির সেক্সুয়াল রেভোল্যুশনের নেগেটিভ লেগেসি। কনজারভেটিভ ওয়েনডি শালিট বলেন, এর সমাধানের উপায় হচ্ছে সেক্সুয়াল রেভোল্যুশন পূর্ব যুগের সেক্সুয়াল মোরালিটি মেইনটেইন করা ও "মডেস্টি"-তে ফিরে যাওয়া। মডেস্টি কালচারে ফিরে যাওয়া বলতে কি মিন করা হচ্ছে তা আমরা অনেকেই বোধ করি জানি। আমাদের দেশের রেলিজিয়াস কনজারভেটিভরা নারীদের মডেস্টি দাবী করে যেমনটা দাবী করেন, এটা অনেকটা সেরকমই।
লিবারাল ফেমিনিস্ট যেমন ক্যামিল প্যাগলিয়া আবার একটু ভিন্ন কথা বলেন। তিনি বলেন, মানুষকে সেক্স অবজেক্ট বানানোটা আসলে আমাদের প্রজাতিরই বিশেষত্ব। তার মতে বোধগম্যতা ও নান্দনিকতার উচ্চ ধরণের সাথে অবজেক্টিফিকেশন গভীরভাবে সম্পর্কিত অথবা একই। বাংলা ঠিক হল না হয়তো, তিনি তার Sexual personae: art and decadence from Nefertiti to Emily Dickinson গ্রন্থে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনকে highest human faculties toward conceptualization and aesthetics এর সাথে ক্লোজলি রিলেটেড বা আইডেন্টিকাল হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
এদিকে ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট ফেমিনিস্ট ওয়েনডি ম্যাকএলরয় দিলেন আরেকটি নতুন ধারণা। তিনি বললেন, নারীর সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফিকেশন মানে হচ্ছে নারীকে সেক্সুয়াল অবজেক্ট ভাবা। এই কথাটি মিনিংলেস কারণ কোন ইনেনিমেট অবজেক্টের মধ্যেই সেক্সুয়ালিটি থাকে না। তিনি আরও বলেন, নারীরা কেবল মাইন্ড ও সৌলই নয় তারা তাদের বডিও। তাই মাইন্ড, বডি, সৌল এগুলোর কোন একটিকে ফোকাস করা হলে তা অবজ্ঞাসূচক হবে না।

অবজেক্টিফিকেশন থিওরি
লিবারাল ও ইন্ডিভিউজুয়ালিস্ট মতবাদ অনুসারে অবজেক্টিফিকেশন অবধারিত, আমাদের মগজটাই এরকম, আর রেডিকেল মতবাদ অনুসারে এটা অর্পিত যার জন্য দায়ী পিতৃতন্ত্র। তবে কারণ যাই হোক, এর এফেক্টকে অস্বীকার করা যায় না। অবজেক্টিফিকেশন থিওরি গড়ে উঠেছিল এভাবে - সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনের মাধ্যমে নারীরা নিজেদের শরীরকে অন্যের দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে তারা তাদের শরীরকে তাদের থেকে আলাদা ভাবতে শুরু করে। আর এখান থেকেই নিজেকে অবজেক্ট মনে করা শুরু হয়। বারবারা ফ্রেডরিকসন ও টমি এন রবার্টস বলেন, এর ফলে লজ্জা, উদ্বিগ্নতা, লিমিটেড পিক মটিভেশনাল স্টেট, ল্যাক অব এওয়ারনেস সহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে হয়। নারীরা অবজেক্টিফিকেশনের ফলে অন্যের অবজারভেশনের ভিত্তিতে নিজেদেরকে পরিবর্তন করে। এই অবজেক্টিফিকেশন সোশ্যাল জেন্ডার রোলকে ইনফ্লুয়েন্স করে, আর লিঙ্গের অসমতা বৃদ্ধি করে। সমাজও তাদেরকে পণ্য হিসেবে দেখতে শুরু করে... - এই ছিল অবজেক্টিফিকেশন থিওরির মূল কথাগুলো।
তবে সেক্সুয়াল রেভোল্যুশনের ফলে বিষয়টা বোধ হয় একটু পরিবর্তিত হল। এখানে নতুন করে সেল্ফ-অবজেক্টিফিকেশন এর ব্যাপার আসল। যেখানে আগের থার্ড পারসন এর ব্যাপারটা আরও বেশি বর্ধিত হল। এখানে এই থার্ড পার্সন হল অডিয়েন্স, ক্যামেরা ইত্যাদি, যেখানে ব্যক্তি মনে করেন আমাকে এত মানুষ দেখবে, তাই আমাকে এভাবে সাজতে হবে বা নিজেকে তৈরি করতে হবে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে সব নারী সমানভাবে এসবে প্রভাবিত হয় না, অনেকেই কম প্রভাবিত হয়। অনেকেই আছে যারা একে অবজেক্টিফিকেশন বলে মনেও করে না, তার কাছে এটা বরং সাবকেক্টিফিকেশন হিসেবে কাজ করতে পারে যেখানে তার লিবারেশন বা স্বাধীনতাই মূখ্য হয়ে ওঠে।

সমাধানের একটি প্রয়াস
সেক্সুয়াল রেভোল্যুশন আমাদের মানষপটেই পরিবর্তন এনে দেয়, যার ফলে অনেকেই একে অবজেক্টিফিকেশন হিসেবে মনে করছেন না, আবার অনেক দর্শকও একে সেক্সুয়াল প্রোডাক্ট হিসেবে মনে করছেন না, জাস্ট এস্থেটিক প্লেজার নেয়ার জন্যই দেখছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মানুষের চিন্তার ভিন্নতাটি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিবেচনায় আনতেই হবে কারণ সব মানুষের বোধ একই রকম না, সবাই একভাবে ভাবেও না। শারীরিক ও মানসিক সমস্যাটা থাকেই, আমার মতে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বাস্থ্যকর এমন বডি স্ট্যান্ডার্ডকে নরমালাইজ করার চেষ্টা করলেই এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়বে, আর ডিপ্রেশন কমবে। বিউটি স্ট্যান্ডার্ড যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়। এখন বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে সৌন্দর্য নিয়ে আমরা বেশি কনজারভেটিভ না হয়ে স্বাস্থ্যের বিষয়ে যত্নশীল হয়ে যথেষ্ট সহিষ্ণু হব সেটাই কাম্য। কেউ সিক্স প্যাক করতে চাইলে নিজের ফিটনেসের জন্য করুক, স্ট্রেংথ-স্টামিনা বাড়ানোর জন্য করুক, বিউটি স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করা প্রত্যক্ষ না হয়ে পরোক্ষ কারণ হোক। আর ভিউয়ার, কনজিউমার, অডিয়েন্স এরও কিছু দায়িত্ব আছে। কেউ সেক্সুয়াল প্লেজার পেলে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, খেয়াল রাখতে হবে সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কোন কিছু নরমালাইজড না হয়, না কারও সেক্সুয়াল প্লেজার পাওয়ার ব্যাপারটাকে সকলের জন্যই স্বাভাবিক এরকম দাবী না করা হয়। সামাজিকভাবে এগুলোকে কেবল এস্থেটিক প্লেজার হিসেবেই নরমালাইজড থাকুক। সোসাইটিতে কারও ব্যক্তিগত সেক্সুয়াল প্লেজার নরমালাইজড হলেই তা সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন তৈরি করবে। কারণ এটা একটা সোশ্যাল ফেনোমেনা। আমার মনে হয় এভাবেই সমস্যাটার সমাধান করা সম্ভব।