শুক্রবার, ৩ জুন, ২০১১

চার্বাক মতবাদ

চার্বাক মতবাদ প্রাচীন ভারতের নিরীশ্বরবাদী মতবাদগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি একই সঙ্গে নিরীশ্বরবাদী, অনাত্মাবাদী এবং ভূতবাদী। এর আরেক নাম লোকায়ত মতবাদ। ভারতের প্রথম বস্তুবাদী চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছিল চার্বাক মতবাদে। এই দর্শনের আরও একটি নাম বস্তুবাদী দর্শন। বৈদিক সাহিত্যে যে ছয়টি শ্রেণীর নাস্তিকের কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে চার্বাক একটি। অন্য ৫টি হল : মাধ্যমিক, যোগাচার, সৌত্রান্তিক, বৈভাষিক ও দিগম্বর।



প্রথমে প্রাচীন বস্তুবাদী মতবাদের নামটা নিয়ে একটু আলোচনা সেরে নেই। আগেই বলে রাখছি, আমি যে 'চার্বাক' শব্দটি লিখছি সেটা বাংলাতে এবং এর বাংলা উচ্চারণও 'চার্বাক'। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় এর উচ্চারণ হল 'চার্বাকা' (चार्वाक, Cārvāka) । অর্থাৎ এখানে চার্বাকের 'ক' এর নিচে কোন হসন্ত ব্যবহার হবে না।



এখন আলোচননায় আসি। 'চার্বাক' শব্দটি কোথা থেকে এলো? অনেক দার্শনিকের মতে 'চারু+বাক্‌' থেকে চার্বাক কথাটি এসেছে। তাদের মতে, মানুষের স্বাভাবিক ভোগ প্রবৃত্তির কথা যে মতবাদে 'চারু' বা সুন্দরভাবে বলে, তাই চার্বাক। চার্বাক মতে, ইহ জগতেই সব কিছুর শেষ। মৃত্যুর পরে অন্য জগত বলে কিছু নেই। অতএব ভোগ কর।


অন্য মতে 'চর্ব' (অর্থাৎ চর্বন) করে যে- এই অর্থে চার্বাক শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই ধরণের ব্যখ্যায় তারা বলতে চান -চর্ব-চোষ্য খানা-পিনার মধ্যেই জীবনের চরমতম স্বার্থকতা যে মতবাদ খুঁজে পায়, তারই নাম চার্বাক দর্শন।


ব্যাকরণ মানতে গেলে দুট মতকেই বাতিল করতে হয়। 'চারু+বাক্‌' থেকে 'চারুবাক্‌' অথবা 'চার্‌বাক্‌' বা 'চার্বাক্‌' ( চার্বাক বা চার্বাকা নয়)। আবার 'চর্বন করে যে' সে চার্বক (চার্বাক বা চার্বাকা নয়)।



পালি সাহিত্য বিষয়ে সুপণ্ডিত রিস দেভিডস (Rhys Davids) - এর মতে মহাভারতের এক কুচরিত্র রাক্ষস চার্বাক-এর নাম থেকেই ভাববাদীরা বস্তুবাদী মতবাদটির নাম রাখেন চার্বাক দর্শন। মহাভারতে আছে- চার্বাক ছিল দুর্যোধনের বন্ধু আর এক দুরাত্মা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ-বিজয়ী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশধারী চার্বাক জ্ঞাতিঘাতী হিসেবে ধিক্ষার জানিয়ে আত্মঘাতী হতে প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু উপস্থিত ব্রাহ্মণগণ তাদের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় চার্বাক-এর আসল পরিচয় জেনে ফেলে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করেন। পাঠকগণ, বুঝতেই পারছেন, প্রাচীন ভাববাদীরা বস্তুবাদী মতবাদটির প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা সৃষ্টির জন্যই এমন এক ঘৃণ্য রাক্ষস চরিত্রের নামে মতবাদটির নাম রেখেছিলেন।

সে'যুগের কিছু ভাববাদী চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদকে দেবগুরু বৃহস্পতি প্রণীত বলে উল্লেখ করেছেন। পুরাণে আছে- অসুরদের পরাক্রমে বিধ্বস্ত দেবকুলকে রক্ষা করতে এক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন দেবগুরু বৃহস্পতি। অসুরদের ধ্বংসের জন্য, অধঃপাতে নিয়ে যাবার জন্য এই ভ্রান্ত মতবাদ রচনা করলেন। তারপর অসুরের ছদ্মবেশে অসুরদের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শনটি প্রচার করলেন। ফলে নীতিভ্রষ্ট, ভ্রান্ত অসুররা দেবতাদের কাছে পরাজিত হল। এখানেও আমরা দেখতে পাচ্ছি- বস্তুবাদী চার্বাক মতবাদই অসুরদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল- এই রকম প্রচারের মধ্য দিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি আতঙ্ক এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা স্পষ্ট।

শঙ্করাচার্য প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকেরা এই মতবাদকে 'লোকায়ত' নামে অবহিত করার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন- দর্শনটি ইতর লোকের দর্শন, তাই 'লোকায়ত' দর্শন। এখানে দার্শনিকদের লোকায়ত মতবাদের প্রতি অশ্রদ্ধা স্পষ্ট।



সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে 'রামায়ণ', 'মহাভারত'- এর মত মহাকাব্যগুলোতে ঢুকে পড়েছে অনেক কাহিনী, অনেক নীতকথা। রামায়নের অযোদ্ধা-কাণ্ডের দিকে তাকান। রামচন্দ্র তখন চিত্রকূটে। ভরত এলেন। রামচন্দ্র ভরতকে রাজ্য-পরিচালন বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন,


ক্কচিন্ন লোকায়তিকান্‌ ব্রাহ্মণাংস্তাত সেবসে।

অনর্থকুশলা হ্যেতে বালাঃ পণ্ডিতমানিনঃ।।


অর্থাৎ, '' আশা করি তুমি লোকায়তিক ব্রাহ্মণদের সেবা করছ না। ওরা অনর্থ ঘটাতে খুবই পটু। "



মহাভারতের শান্তিপর্ব। এক ধনী বণিক অথে যাবার সময় এক ব্রাহ্মণকে ধাক্কা মারে। ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ অপমানের জ্বালা ভুলতে আত্মহত্যা কথা চিন্তা করে। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের আত্মহত্যার মধ্যে সর্বনাশের সংকেত দেখতে পেয়ে শিয়াল সেজে হাজির হলেন। ব্রাহ্মণকে পশুজীবনের বহু কষ্টের কথা বলে মানবজীবনের জয়গান গাইলেন। জানালেন, অনেক জন্মের পর পুণ্যের ফল সঞ্চয় করে এই মানবজন্ম পাওয়া। এমন মহার্ঘতম মানবজীবন, বিশেষত শ্রেষ্ঠ মানুশ হিসেবে ব্রাহ্মণ হয়েই জন্মলাভের পরেও কেউ কি পারে সে-জীবন ধ্বংস করতে? অভিমানে আত্মহত্যা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শিয়াল, সে নিজেও আগের জন্মে ব্রাহ্মণ কয়েই জন্মেছিল। কিন্তু সে জন্মে চূড়ান্ত মূর্খের মত এক মহাপাতকের কাজ করেছিল বলেই আজ এই শিয়ালের জন্ম।


চূড়ান্ত মূর্খের মত কাজটা কী? এ-বারেই বেরিয়ে এল নিতিকথা -

অহমাংস পণ্ডিতকো হৈতুকো দেবনিন্দকঃ।

আন্বীক্ষিকীং তর্কবিদ্যম্‌ অনুরক্তো নিরার্থিকাম।।

হেতুবাদান্‌ প্রবদিতা বক্তা সুংসৎসু হেতুমৎ।

আক্রোষ্টা চ অভিবক্তা চ ব্রাহ্মবাক্যেষু চ স্বিজান্‌।।

নাস্তিকঃ সর্বশঙ্কী চ মূর্খঃ পণ্ডিতমানিকঃ।

ভাস্য ইয়ং ফলনিবৃত্তিঃ শৃগালত্বং মম দ্বিজ।।

(শান্তিপর্ব- ১৮০/৪৭-৪৯)


অর্থাৎ, আমি ছিলাম এক বেদ-সমালোচক তার্কিক পণ্ডিত। নিরর্থক তর্কবিদ্যায় ছিলাম অনুরক্ত। বিচারসভায় ছিলাম তর্কবিদ্যার প্রবক্তা। যুক্তিবলে দ্বিজদের ব্রহ্মবিদ্যার বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটাতাম। ছিলাম জিজ্ঞাসু মনের নাস্তিক। অর্থাৎ কিনা পাণ্ডিত্যভিমানী মূর্খ। হে ব্রাহ্মণ, তারই ফলস্বরূপ আমার এই শিয়ালজন্মও।



পাঠক-পাঠিকা গণ, আশা করি আপনাদের মাথায় নিশ্চই এখন উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে, চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদে কি এমন কথা বলা হয়েছে, যা অবহেলায় পাশে সরিয়ে দেয়ার সাধ্য সে যুগের রথী-মহারথী দার্শনিকদের ছিল না (যদিও প্রক্ক্রিত অর্থে তারা কেউই 'দার্শনিক' ছিলেন না।) যার ফলে ভাববাদী রথী-মহারথীরা বস্তুবাদী এই মতবাদকে লক্ষ্য করে তীক্ষ্ণ আক্তমণ করেছেন? সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষদের দর্শনটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন?




ভারতবর্ষে আধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী সর্শনের সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখতে পাই আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে 'উপনিষদ' সাহিত্যে। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন বা বস্তুবাদী যুক্তিবাদের সূচনা সঠিক কবে হয়েছিল বলা সম্ভব নয়। তবে আনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীলের ব্যাখ্যা-গ্রন্থ 'পঞ্জিকা'তে বস্তুবাদী চার্বাক মতবাদের উল্লেখ রয়েছে দেখতে পাই।



কমলশীলের গুরু শান্তরক্ষিত নিজের মতের সমর্থনে 'তত্ত্বসংগ্রহ' নামে একটি দর্শনগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচনায় দেখতে পাই বস্তুবাদী যুক্তি-তর্ক নির্ভর মতবাদকে তিনি 'চার্বাক' না বলে 'লোকায়ত' বলে বর্ণনা করেছিলেন।



শান্তরক্ষিত থেকে শঙ্করাচার্য পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বিখ্যাত আধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী দার্শনিকের রচনায় 'লোকায়ত' বা 'চার্বাক' নামের যুক্তি-তর্ক নির্ভর মতবাদটির উল্লেখ আছে। সে সময় ভারতীয় দর্শনের প্রথামত পরমত খণ্ডণ করে নিজের মত স্থাপন করা হত। পরমত হিসেবেই এইসব ভাববাদী দার্শনিকেরা চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করেছেন। আর সেই উল্লেখ থেকেই আমরা চার্বাক দর্শন বিষয়ে কিছু জানতে পারি। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দর্শন, যা ছড়া হিসেবে প্রচলিত ছিল মানুষের মুখে মুখে। অলিখিত এই ছড়াই লোকগাথার রূপ পেয়েছিল।



আত্মা অবিনশ্বর হলে তবেই মৃত্যুর পর আসে স্বর্গ নরক ভোগের প্রশ্ন, জন্মান্তর পূর্বজন্মের কর্মফল ইত্যাদি প্রশ্ন। আত্মা নশ্বর হলে এইসব প্রশ্নই অর্থহীন হয়ে যায়।

চার্বাক বা লোকায়ত-দর্শনে আত্মার বিষয়ে এমন কিছু যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল যেগুলো ইতরজন বা সাধারণের কাছেও গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল।

চার্বাক দর্শনে আত্মা বা চৈতন্যকে দেহধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই বক্তব্যই ভাববাদী দার্শনিকের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের সঙ্গে ভাববাদী দর্শনের। সুদীর্ঘ লড়াই চলেছিল শুধুমাত্র আত্মা 'অমর' কি 'মরণশীল' এই নিয়ে।



লোকায়ত দর্শন মতে- কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য প্রমাণের প্রয়োজন। বিশ্বাস-নির্ভর অনুমানের সাহাহ্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। অনুমান-নির্ভর, একান্ত বিশ্বাস-নির্ভর অমর আত্মা, ইহলোক, পরলোক ইত্যাদি ধারণাগুলো লোক ঠকানোর জন্য একদল ধূর্ত লোকের সৃষ্টি।



প্রমাণের জন্য প্রত্যক্ষ প্রমাণই শ্রেষ্ঠ বলে চার্বাক দর্শন মনে করলেও প্রত্যক্ষ অনুগামী জ্ঞানকেও মর্যাদা দিয়েছিল। অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রতিটি অনুমানের মূল শর্ত অবশয়ই হবে 'পূর্ব প্রত্যক্ষ' অর্থাৎ প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করে অনুমান। যেমন ধোঁইয়া দেখলে আগুনের অনুমান, গর্ভ দেখলে অতীত মৈথুনের অনুমান ইত্যাদি।



ভাববাদীদের চোখে প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের গুরুত্ব ছিল সামান্য অথবা অবান্তর। তারা অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন, 'ঋষি' নামধারী ধর্মগুরুদের মুখের কথাকে, ধর্মগুরুদের অন্ধ-বিশ্বাসকে যার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল আত্মা সংক্রান্ত মতবাদ বা আধ্যাত্মবিদ্যা।



আজও যারা বলেন, "বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্ম এবং আধ্যাত্মবাদের কোন দ্বন্দ্ব নেই, বরং আধ্যাত্মতত্বই 'পরম বিজ্ঞান', তারা এটা ভুলে যান- প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া প্রকৃত বিজ্ঞানের প্রথম ধাপটিতে পা রাখাই সম্ভব নয়। আর আধ্যাত্মতত্ব দাঁড়িয়ে আছে 'আত্মা অমর' এই বিশ্বাসের উপর, যা বিজ্ঞান-বিরোধী বিশ্বাস।



লোকায়ত দর্শন প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ অনুগামী জ্ঞানের উপর নির্ভর করে দ্বিধাহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিল- চৈতন্য দেহেরই গুণ বা দেহেরই ধর্ম। দেহ ধ্বংস হওয়ার পর চৈতন্যস্বরূপ আত্মার অস্তিত্ব অজ্ঞান ও ধূর্তদের কল্পনা মাত্র। আর 'আধ্যাত্মতত্ত্ব' বা আত্মার অবিনশ্বরতার উপর নির্ভর করে ওঠা তত্ত্ব বিজ্ঞানের লক্ষণ নয় ; অজ্ঞানের লক্ষণ।



লোকায়ত দর্শনের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে শংকরাচার্য যে যুক্তি দিয়েছিলেন তা হল- লোকায়তদের মতে দেহের মূল উপাদান জল, মাটি, আগুন, বায়ু ইত্যাদি ভূত-পদার্থ। এই প্রতিটি পদার্থই জড় বা অচেতন পদার্থ। তাহলে এই অচেতন পদার্থে গড়া মানুষের মধ্যে চেতনা আসছে কোথা থেকে? আসছে নিশ্চই এই সব অচেতন পদার্থের বাইরে থেকেই। অতএব স্বীকার করে নেয়া উচিৎ- চৈতন্য বা আত্মা দেহের অতিরিক্ত একটা কিছু। আত্মা বিষয়ে অন্যান্য বহু আধ্যাত্মবাদী দার্শনিক যে সব তর্কের ঝড় তুলেছেন, তাঁদের অনেকের বক্তব্যেই শংকরাচার্যের এই যুক্তির সুর লক্ষ্য করা যায়। তাঁরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন- জড় বা অচেতন পদার্থে গড়া দেহ তো সরল যুক্তিতে অচেতনই হবার কথা। তবে মানুষের চৈতন্য আসছে কোথা থেকে?



লোকায়ত দর্শন এই যুক্তির বিরুদ্ধে পালটা যুক্তিও হাজির করেছে - মদ তৈরির উপকরণগুলোতে আলাদা করে কোন মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলোকেই এক ধরণের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিলন ঘটানোর পর সম্পূর্ণ নতুন এক গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে বলছি মদ। আত্মা বা চৈতন্যও একই জাতীয় ঘটনা।

লোকায়তিকদের চৈতন্যএর সঙ্গে মদশক্তির তুলনা নিয়ে কোন বিপক্ষ দার্শনিকই কুটতর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি। তবে, দৃষ্টান্ত হিসেবে এনেছেন মৃতদেহের তুলনা। চৈতন্য যদি দেহেরই লক্ষণ বা ধর্ম হয়, তবে মৃতদেহেও তো চৈতন্য থাকার কথা, থাকেনা কেন?



লোকায়ত দর্শনের আত্মা বা চৈতন্যতত্ত্বের কাছে এটাই সবচেয়ে জোরালতম যুক্তি। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন এর বিপক্ষে জোরাল কোন যুক্তি আর হাজির করতে পারেনি। প্রাচীনকালের পটভূমিতে শারিরবিদ্যার অনগ্রসরতার যুগে এই ধরনের যুক্তির কোন উত্তর দেয়া সম্ভব ছিল না। আজ বিজ্ঞানের তথা শারীর-বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক কিছুই জেনেছি, তারই ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি দেহ ও মৃতদেহের ধর্ম সমান নয়। চিন্তা, চেতনা বা চৈতন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ক্রিয়া।



মৃতদেহের ক্ষেত্রে মৃতদেহেরই অংশ মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের যেহেতু মৃত্যু ঘটে তাই স্নায়ুকোষের ক্রিয়াও ঘটে না, ফলে মৃতদেহের ক্ষেত্রে চৈতন্য বা চিন্তা থাকে অনুপস্থিত।

লোকায়ত দর্শনে আত্মা, পরলোক এবং পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে এমন অনেক যুক্তি দেখান হয়েছে, যেসব যুক্তি এযুগের যুক্তিবাদীদেরও ঈর্ষা জাগাবার মত। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এর সম্পাদক প্রবীর ঘোষ চার্বাক দর্শনের কিছু শ্লোকের কাব্যানুবাদ করেছেন। কিছু উদাহরণ দেয়া হল :



১. ব্রাহ্মণ জীবিকা হেতু তৈরি শ্রাদ্ধাদি বিহিত।

এছাড়া কিছুই নয় জেনো গো নিশ্চিত।।


- ব্রাহ্মণেরা তাদের জীবিকার তাগিদেই 'শ্রাদ্ধ' নামক নিয়ম চালু করেছে। পয়সা কামানোর অজুহাত ছাড়া শ্রাদ্ধ আর কিছুই নয়।



২. যদি, শ্রাদ্ধকর্ম হয় মৃতের তৃপ্তির কারণ।

তবে, নেভা প্রদীপে দিলে তেল উচিৎ জ্বলন।।


- শ্রাদ্ধকর্মের ফলে যদি মৃতের তৃপ্তি হয় তাহলে নেভা প্রদীপে তেল দিলেও আগুন জ্বলা উচিৎ।



৩. পৃথিবি ছেড়ে যে ভূতপদার্থে ফেরে তার পাথেও দিতে পিণ্ডদান বৃথা।

যেমন, ঘর যে গ্রামান্তরে তার পাথেও ঘরে দেয়া বৃথা।।


- বিদেশে থাকা পরিবারের সদস্যের জন্য দেশে বসে রান্না করা বৃথা, ঠিক তেমনি মৃতের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করাও বৃথা।



৪. চৈতন্যরূপ আত্মার পাকযন্ত্র কোথা?

তবে তো পিণ্ডদান নেহাতই বৃথা।।


- আত্মার কি পাকস্থলী আছে? যদি না থাকে তাহলে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করলে সে খাবে পিণ্ড বা মাংস খাবেই বা কিভাবে আবার হজম করবেই বা কিভাবে?



৫. যদি জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে বলি দিলে পশু যায় স্বর্গে।

তবে, পিতাকে পাঠাতে স্বর্গে ধরে-বেধে বলি দাও যজ্ঞে।।


- জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে পশুবলি দিলে যদি পশু স্বর্গেই গিয়ে থাকে, তাহলে পিতাকে স্বর্গে পাঠানোর জন্য তাকে ধরে-বেধে যজ্ঞে বলি দিলেই তো হয়, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দরকার কী?




৬. ভণ্ডরা পশুর মাংস খেতে অজুহাত চান।

তাই তারা দিয়েছেন বলির বিধান।।


- ব্রাহ্মণেরা পশুহত্যা মহাপাপ বলেছিলেন। তারা হিন্দুদের নিরামিষ ভোজনের বিধান দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজেরা মাংস খাওয়ার লোভ সামলাতে পারেন নি। তাই ব্রাহ্মণদের আমিষ খাওয়া নিশিদ্ধ হলেও যজ্ঞে উৎসর্গকৃত পশুর মাংস তারা খেতেই পারতেন। তাই তারা যজ্ঞে পশুবলির বিধান দেন।




বুদ্ধের পর চার্বাক দর্শনের বিকাশের কোন খবর আমরা পাইনি।তার কারণ হতে পারে,

১. বৌদ্ধ দর্শন চার্বাক দর্শন অপেক্ষা অনেক উন্নততর, সংঘবদ্ধ, সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য দর্শন ছিল।

২.বৌদ্ধ দর্শনের আবির্ভাব ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বৌদ্ধ অনুরাগিদের অগ্রগমন, পিছিয়ে থাকা চার্বাক দর্শনকে আরো পিছিয়ে দিয়েছিল।

৩. চার্বাক দর্শনের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মগজ ধোলাই।



ফলে আমরা দেখতে পেলাম, যে শোষিত সাধারণ মানুষদের উপকারের জন্য চার্বাক দর্শন আত্মাবাদ ও ঈশ্বরবাদকে শানিত যুক্তিতে খণ্ডন করেছিল, সেই শোষিত সাধারণ মানুষই একসময় চার্বাক দর্শনকে এক নীতিহীন দর্শন বলে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। এমনকি 'চার্বাক' শব্দটিকে লোকে গালাগাল বলেই ভাবতে শুরু করেছিল।



উপাসনা-ধর্মে বিশ্বাসীরা (উপাসনা ধর্ম বলতে ইংরেজি 'religion' শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দকে বোঝাতে চাইছি। শুধু 'ধর্ম' শব্দটির দ্বারা ইংরেজি 'property' শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ বোঝায়) চার্বাকদের আরো নানা নামে চিহ্নিত করেছিল- লোকায়ত, বৃহস্পত্য, স্বাভাবিক, ভূতবাদী ইত্যাদি। চার্বাকেরা মনে করতেন, জগৎ স্বভাবগতভাবেই বৈচিত্র্যময় ও বৈচিত্র্যের কারণ। অতএব ঈশ্বরকে বৈচিত্র্যের স্রষ্টা ভাবাটা ভূল। ভূতবাদী হিসেবে ওরা মনে করতেন- ক্ষিতি বা পৃথিবী, অপ বা জল, তেজ বা আগুন ও মরুৎ বা বায়ু থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি। ধ্বংসে সবই আবার এই চার ভূতেই বিলীন হয়।



'ভূতবাদ' মনে করত, পৃথিবীতে পদার্থেও পরিমাণ পাঁচ। আবার কিছু ভূতবাদীদের মতে পৃথিবীতে মৌলিক পদার্থের পরিমাণ চার। এই মৌলিক পদার্থ থেকেই পৃথিবীর বস্তু ও প্রাণীর সৃষ্টি। ধ্বংসে আবার সবই পঞ্চভূতে বা চার ভূতে বিলীন হয়। এই মৌলগুলো কী কী তা আমরা আগেই জেনেছি। এখন আমরা এই চারটি বা পাঁচটি মৌলিক পদার্থের তত্ত্ব মেনে নিতে পারব না। তাদের বর্ণিত মৌলিক পদার্থগুলোর মধ্যে একটিও প্রকৃত অর্থে মৌলিক পদার্থ নয়। আজ আমরা জানি এই পর্যন্ত আবিষ্কৃত মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ১১১টি। কিন্তু পাঠক পাঠিকাগণ আপনারা এই তত্ত্ব কোন যুগের সেটা একটু বিবেচনায় আনুন। একটু বিবেচনা করলে স্বীকার করে নিতেই হয়, আজ থেকে দু'আড়াই হাজার বছর আগের কিছু চিন্তাবিদ কী অসাধারণ বিপ্লবাত্মক চিন্তায় পৌঁছেছিলেন- সব কিছুই মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত এবং মৃত্যুর পর মৃতদেহ মৌলিক পদার্থে বিলীন হয়ে যায়। দেহাতীত আত্মা বলে কিছু নেই। এমন চিন্তা মানুষের মাথায় এসেছিল সম্ভবত মৃত্যুর পর দেহের পরিণতি দেখে, অস্ত্র ও তৈজস্পত্রের ভঙ্গুরতা দেখে। মৃতদেহকে পচে-গলে মাটিতে মিশে যেতে দেখে, পূড়ে ছাই হয়ে শেষ হয়ে যেতে দেখে। অনুমান করে বলা যেতে পারে, তাদের এসব প্রত্যক্ষ প্রমাণ চতুর্ভূত বা পঞ্চভূত তত্ত্বে পৌঁছে দিয়েছিল।



সে সময়ের প্রেক্ষিতে চতুর্ভূত বা পঞ্চভূত তত্ত্বকে অবশ্যই অসাধারণ বলতেই হয়। দুঃখ এই, আজকের যুগে যেখানে মৌলিক পদার্থ নিয়ে বিজ্ঞানের গবেষণা যখন বিশাল রকম এগিয়ে গেছে, শারীরবিদ্যা নিয়ে গবেষণাও যখন অনেক দূরে এগিয়ে গেছে, সেখানে কিছু মানুষ আজও বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পর দেহ মাটিতে পুঁতে ফেললেও, আগুনে পুড়িয়ে দেবার পরও সব শেষ হয় না, বেঁচে থাকে আত্মা, অর্থাৎ চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মন। আড়াই হাজার বছরে বিজ্ঞান অনেক এগোলো, কিন্তু আমাদের চেতনা এগোলো কই? আমরা তো যুক্তিহীনতার আবর্তে তলিয়ে যাচ্ছি। এই অধঃপাতকেই কি আমরা মেনে নেব?

২টি মন্তব্য:

  1. prottek ta lekha porei khub valo lagche, ank kichu janteu parchi.

    উত্তরমুছুন
  2. দারুন সুন্দর লেখা। পরিষ্কার যুক্তি। সঠিকভাবে মানুষকে বোঝানো হয়েছে। Excellent!

    উত্তরমুছুন