শনিবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৭

সেক্সুয়াল অবিজেক্টিফিকেশন নিয়ে কিছু কথা

(একটা স্ট্যাটাসের কমেন্ট হিসেবে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন নিয়ে কিছু কথা লিখেছিলাম। সেটাই এখানে দিচ্ছি। যেহেতু স্ট্যাটাসের জবাবে লেখা তাই সব সেক্সুয়াল অনজেক্টিফিকেশন নিয়ে এই লেখা আংশিক, পূর্ণাঙ্গ নয়। এটা দুটো বিষয়কে সামনে রেখে লেখা হয়েছে, যথা - 'একই কাজ নারী করলে সে হয়ে যায় পণ্য, আর পুরুষ করলে সে হয়ে যায় অভিনেতা' এবং 'সমস্যা কি শুধুই উপস্থাপনে, নাকি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মগজে?'। শেষে এই সমস্যার সমাধান দেবার একটা চেষ্টা করা হয়েছে।)
পুরুষের সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন
সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন যে কেবলমাত্র নারীর সাথে হবারই বিষয়, আর যে কাজ নারী করলে পণ্য কিন্তু পুরুষ করলে পণ্য না হয়ে কেবল অভিনেতা - এই ধারণা সঠিক নয়। পুরুষরাও সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনের শিকার হয়।
বিষয়টি সম্ভবত সবার আগে ফেমিনিস্ট অথর নাওমি ওল্ফ আর ক্রিশ্চিনা হফ সমারস তুলে এনেছিলেন। তারা বলেন, উইমেন সেক্সুয়াললিবারেশন নারীদেরকে রোল রিভার্সালের দিকে নিয়ে যেতে পারে, আর এরপর তারা পুরুষকেও সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফাই করতে পারে, এক্ষেত্রে যেভাবে নারীদের অবজেক্টিফাই করার জন্য পুরুষকে সমালোচিত করা হয়, সেরকমই নারীদেরও সমালোচিত করা যায়। সাইকোলজিস্ট হ্যারল্ড লিয়ন বললেন নারীর মুক্তির জন্য পুরুষের মুক্তিও দরকার। গবেষণায় দেখা গেল, অবজেক্টিফিকেশন নারীদের মত পুরুষদেরকেও প্রভাবিত করে, তাদের মধ্যে নেগেটিভ বডি ইমেজ তৈরি করে। ওয়েস্টার্ন সোসাইটিতে সেক্সুয়াল রেভোল্যুশনের সাথে সাথে দেখা গেল বিভিন্ন এডভারটাইজমেন্ট, মিউজিক ভিডিও, টেলিভিশন শো, উইমেনস ম্যাগাজিন, মেলস স্ট্রিপ শো, CFNM ইভেন্ট ইত্যাদিতে পুরুষের অবজেক্টিফিকেশন দেখা যায়। নারীদেরকে পর্নোগ্রাফিও কিনতে দেখা যায়।
নারীর অবজেক্টিফিকেশনে সমাজের গেইজ পড়ে যাওয়ায়, পুরুষের অবজেক্টিফিকেশন চোখে পড়ে না। কিন্তু গবেষণায় উঠে আসে ৩৭ শতাংশ বিজ্ঞাপনেই পুরুষের অঙ্গকে প্রোডাক্ট হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আর সাইকোলজিকালি পুরুষদেরকেও এই অবজেক্টিফিকেশন বডি শেমিং, ইটিং ডিজর্ডার, পারফেকশন কামনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, ঠিক যেমনটা নারীদের বেলাতে হয়। দেখা যায় বডি ইভাল্যুশন এর বেলায় যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করা হচ্ছে সেটা অর্জন করতে গিয়ে এরা স্টেরয়েড গ্রহণ করছে, অনেকেই "আইডিয়াল ম্যান" হবার স্বপ্নে বিভোর। যাদের এই আইডিয়াল বডি শেপ নেই, তাদেরকে আমরা কমিক রিলিফ বলি, আর চাইনা যে এরা কোন টিভি শো বা মুভিতে লিডিং রোলে আসুক। এই ব্যাপারটা আমাদের মাইন্ডসেটকেই বদলে ফেলছে। তবে সেল্ফ অবজেক্টিফিকেশনের ব্যাপারটা নারীদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়, আর নারীরা যেভাবে নেতিবাচকভাবে ভুক্তভোগী হয়, পুরুষেরা সেই তুলনায় কম হয়।

সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন সম্পর্কিত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি
সমস্যাটা কোথায়? শুধুই উপস্থাপনে নাকি মগজে এটা নিয়ে ফেমিনিস্ট থিওরিতে অনেক আলোচনা হয়েছে, সেই সাথে এর সাথে সম্পর্কিত নৈতিক বিষয়গুলো নিয়েও। নাওমি ওল্ফ বলেছেন, ফিজিকাল এট্রাকটিভনেস জিনিসটাই আসলে সমস্যার। এট্রাকটিভনেস জিনিসটা থাকে বলেই, একটা বিশেষ ধরণ আমাদেরকে এট্রাক্ট করে বলেই আসলে এটা হয়ে থাকে। আমরা সকলেই আসলে এদিক থেকে বায়াজড, মানে সবার মগজেই সমস্যা। এদিকে রেডিকেল ফেমিনিস্টরা কোন ব্যক্তির ফিজিকাল ক্যারেকটারিস্টিকসের উপর যে তার সেক্সুয়াল এট্রাকটিভনেস নির্ভর করে তা মানতে নারাজ। তাদের মতে এগুলো আসলে মানুষের চয়েস। কেউ চাইলে নিজেকে এভাবে তৈরি করে উপস্থাপন করতে পারে যা অবজেক্টিফিকেশনকে ত্বরান্বিত করে। তাদের মতে এই সমস্যাটা মগজে ময়, উপস্থাপনে।
রেডিকেল ফেমিনিজম অনুসারে নারীদেরকে অপ্রেসড সেক্স ক্লাস বানানোর মূলে হচ্ছে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন। অনেক রেডিকেল ফেমিনিস্ট ভাবেন, আমাদের মিডিয়া পুরুষতান্ত্রিক বলে তা অবজেক্টিফাই করে, পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে তারা পুরুষদেরকে নারীদের অবজেক্টিফাই করতে হ্যাবিচুয়েট করে।
কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীলরা এই অবজেক্টিফিকেশন নিয়ে ফেমিনিস্ট ক্রিটিককে নিজেদের সুবিধায় ব্যবহার করে। তারা যেহেতু সেক্সুয়াল রেভোল্যুশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাই তারা বলে এই সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন হচ্ছে ওয়েস্টার্ন সোসাইটির সেক্সুয়াল রেভোল্যুশনের নেগেটিভ লেগেসি। কনজারভেটিভ ওয়েনডি শালিট বলেন, এর সমাধানের উপায় হচ্ছে সেক্সুয়াল রেভোল্যুশন পূর্ব যুগের সেক্সুয়াল মোরালিটি মেইনটেইন করা ও "মডেস্টি"-তে ফিরে যাওয়া। মডেস্টি কালচারে ফিরে যাওয়া বলতে কি মিন করা হচ্ছে তা আমরা অনেকেই বোধ করি জানি। আমাদের দেশের রেলিজিয়াস কনজারভেটিভরা নারীদের মডেস্টি দাবী করে যেমনটা দাবী করেন, এটা অনেকটা সেরকমই।
লিবারাল ফেমিনিস্ট যেমন ক্যামিল প্যাগলিয়া আবার একটু ভিন্ন কথা বলেন। তিনি বলেন, মানুষকে সেক্স অবজেক্ট বানানোটা আসলে আমাদের প্রজাতিরই বিশেষত্ব। তার মতে বোধগম্যতা ও নান্দনিকতার উচ্চ ধরণের সাথে অবজেক্টিফিকেশন গভীরভাবে সম্পর্কিত অথবা একই। বাংলা ঠিক হল না হয়তো, তিনি তার Sexual personae: art and decadence from Nefertiti to Emily Dickinson গ্রন্থে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনকে highest human faculties toward conceptualization and aesthetics এর সাথে ক্লোজলি রিলেটেড বা আইডেন্টিকাল হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
এদিকে ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট ফেমিনিস্ট ওয়েনডি ম্যাকএলরয় দিলেন আরেকটি নতুন ধারণা। তিনি বললেন, নারীর সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফিকেশন মানে হচ্ছে নারীকে সেক্সুয়াল অবজেক্ট ভাবা। এই কথাটি মিনিংলেস কারণ কোন ইনেনিমেট অবজেক্টের মধ্যেই সেক্সুয়ালিটি থাকে না। তিনি আরও বলেন, নারীরা কেবল মাইন্ড ও সৌলই নয় তারা তাদের বডিও। তাই মাইন্ড, বডি, সৌল এগুলোর কোন একটিকে ফোকাস করা হলে তা অবজ্ঞাসূচক হবে না।

অবজেক্টিফিকেশন থিওরি
লিবারাল ও ইন্ডিভিউজুয়ালিস্ট মতবাদ অনুসারে অবজেক্টিফিকেশন অবধারিত, আমাদের মগজটাই এরকম, আর রেডিকেল মতবাদ অনুসারে এটা অর্পিত যার জন্য দায়ী পিতৃতন্ত্র। তবে কারণ যাই হোক, এর এফেক্টকে অস্বীকার করা যায় না। অবজেক্টিফিকেশন থিওরি গড়ে উঠেছিল এভাবে - সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনের মাধ্যমে নারীরা নিজেদের শরীরকে অন্যের দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে তারা তাদের শরীরকে তাদের থেকে আলাদা ভাবতে শুরু করে। আর এখান থেকেই নিজেকে অবজেক্ট মনে করা শুরু হয়। বারবারা ফ্রেডরিকসন ও টমি এন রবার্টস বলেন, এর ফলে লজ্জা, উদ্বিগ্নতা, লিমিটেড পিক মটিভেশনাল স্টেট, ল্যাক অব এওয়ারনেস সহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে হয়। নারীরা অবজেক্টিফিকেশনের ফলে অন্যের অবজারভেশনের ভিত্তিতে নিজেদেরকে পরিবর্তন করে। এই অবজেক্টিফিকেশন সোশ্যাল জেন্ডার রোলকে ইনফ্লুয়েন্স করে, আর লিঙ্গের অসমতা বৃদ্ধি করে। সমাজও তাদেরকে পণ্য হিসেবে দেখতে শুরু করে... - এই ছিল অবজেক্টিফিকেশন থিওরির মূল কথাগুলো।
তবে সেক্সুয়াল রেভোল্যুশনের ফলে বিষয়টা বোধ হয় একটু পরিবর্তিত হল। এখানে নতুন করে সেল্ফ-অবজেক্টিফিকেশন এর ব্যাপার আসল। যেখানে আগের থার্ড পারসন এর ব্যাপারটা আরও বেশি বর্ধিত হল। এখানে এই থার্ড পার্সন হল অডিয়েন্স, ক্যামেরা ইত্যাদি, যেখানে ব্যক্তি মনে করেন আমাকে এত মানুষ দেখবে, তাই আমাকে এভাবে সাজতে হবে বা নিজেকে তৈরি করতে হবে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে সব নারী সমানভাবে এসবে প্রভাবিত হয় না, অনেকেই কম প্রভাবিত হয়। অনেকেই আছে যারা একে অবজেক্টিফিকেশন বলে মনেও করে না, তার কাছে এটা বরং সাবকেক্টিফিকেশন হিসেবে কাজ করতে পারে যেখানে তার লিবারেশন বা স্বাধীনতাই মূখ্য হয়ে ওঠে।

সমাধানের একটি প্রয়াস
সেক্সুয়াল রেভোল্যুশন আমাদের মানষপটেই পরিবর্তন এনে দেয়, যার ফলে অনেকেই একে অবজেক্টিফিকেশন হিসেবে মনে করছেন না, আবার অনেক দর্শকও একে সেক্সুয়াল প্রোডাক্ট হিসেবে মনে করছেন না, জাস্ট এস্থেটিক প্লেজার নেয়ার জন্যই দেখছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মানুষের চিন্তার ভিন্নতাটি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিবেচনায় আনতেই হবে কারণ সব মানুষের বোধ একই রকম না, সবাই একভাবে ভাবেও না। শারীরিক ও মানসিক সমস্যাটা থাকেই, আমার মতে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বাস্থ্যকর এমন বডি স্ট্যান্ডার্ডকে নরমালাইজ করার চেষ্টা করলেই এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়বে, আর ডিপ্রেশন কমবে। বিউটি স্ট্যান্ডার্ড যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়। এখন বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে সৌন্দর্য নিয়ে আমরা বেশি কনজারভেটিভ না হয়ে স্বাস্থ্যের বিষয়ে যত্নশীল হয়ে যথেষ্ট সহিষ্ণু হব সেটাই কাম্য। কেউ সিক্স প্যাক করতে চাইলে নিজের ফিটনেসের জন্য করুক, স্ট্রেংথ-স্টামিনা বাড়ানোর জন্য করুক, বিউটি স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করা প্রত্যক্ষ না হয়ে পরোক্ষ কারণ হোক। আর ভিউয়ার, কনজিউমার, অডিয়েন্স এরও কিছু দায়িত্ব আছে। কেউ সেক্সুয়াল প্লেজার পেলে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, খেয়াল রাখতে হবে সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কোন কিছু নরমালাইজড না হয়, না কারও সেক্সুয়াল প্লেজার পাওয়ার ব্যাপারটাকে সকলের জন্যই স্বাভাবিক এরকম দাবী না করা হয়। সামাজিকভাবে এগুলোকে কেবল এস্থেটিক প্লেজার হিসেবেই নরমালাইজড থাকুক। সোসাইটিতে কারও ব্যক্তিগত সেক্সুয়াল প্লেজার নরমালাইজড হলেই তা সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন তৈরি করবে। কারণ এটা একটা সোশ্যাল ফেনোমেনা। আমার মনে হয় এভাবেই সমস্যাটার সমাধান করা সম্ভব।

শনিবার, ৪ জুন, ২০১১

প্রাচীন ভারতীয় নাস্তিক্যবাদ

আমরা অনেকেই মনে করি যে নাস্তিক্যবাদ বা নিরীশ্বরবাদ হল একটি আধুনিক মতবাদ। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এই মতবাদ তেমন নতুন কিছু নয়। আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগেও আমাদের উপমহাদেশেই এই নাস্তিক্য মতবাদ ছিল যা আমরা অনেকেই জানি না।


আমরা জানি, নাস্তিক শব্দটির অর্থ হল যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। বৈদিক সাহিত্য অবশ্য নাস্তিক শব্দএর একটু অন্য ধরণের বিস্তৃত অর্থ তৈরি করেছে। যথা-

১. যে বেদ মানে না।
২. যে বেদকে অপৌরুষেয় অর্থাৎ ঈশ্বর সৃষ্ট মনে করে না।
৩. যে বেদকে অভ্রান্ত মনে করে না,
৪. যে দেশাচার মানে না,
৫. যে পরলোকে বিশ্বাস করে না।
৬. যে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না।


বৈদিক সাহিত্যে ছ'টি শ্রেণীর নাস্তিকের কথা বলা হয়েছে। যথা - ১. মাধ্যমিক, ২. যোগাচার, ৩. সৌত্রান্তিক, ৪. বৈভাষিক, ৫. চার্বাক ও ৬. দিগম্বর।


প্রাচীন ভারতঈয় নাস্তিক্যবাদী দর্শন নিয়ে আলোচনার আগে আমরা এই বৈদিক সাহিত্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত ৬ শ্রেণীর নাস্তিকদের নিয়ে ছোট্ট করে কিছু আলোচনা সেরে নেই।


১. মাধ্যমিক
নাগার্জুন মাধ্যমিক মতবাদের প্রবক্রা। এটি একটি মহাযানপন্থী বৌদ্ধ দর্শন। মাধ্যমিক মতে- আমরা যা দেখি, যা অনুভব করি, সবই আপেক্ষিক ভাবে মনে হওয়া, অনুভব করা। আলোয় যে প্রকৃতিকে আমরা দেখতে পাই, অন্ধকারে তা দেখা যায় না। চোখ না থাকলে জগতের বস্তু, রঙ সবই মিথ্যা। যে দ্রব্য একজন দুর্বল দ্বারা পরীক্ষিত হলে কঠিন মনে হয়, তাই একজন সবলের কাছে কম কঠিন অনে হয়। গুণাবলী স্বয়ং অস্তিত্ববান হতে পারে না। যে খাদ্যবস্তুর স্বাদ একজনের কাছে উপাদেয়, অপরের কাছে খারাপ মনে হতে পারে। সুতরাং বস্তুর বাস্তব গুণ নেই। বস্তুগুণ আপেক্ষিক।


একটি বস্তুর মধ্যে একই সঙ্গে সৃষ্টি-স্থিতি-লয় থাকতে পারে না। জগতের প্রকৃত কোনও অস্তিত্ব নেই। বস্তুসমূহ চীরস্থায়ীও নয়, ক্ষণস্থায়ীও নয়। বস্তু উৎপন্নও হয় না, বিলুপ্তও হয় না। আমরা যে সব বস্তু দেখছি তা আসলে অলীক।


মাধ্যমিক দর্শন কিছু যুক্তি ও কিছু যুক্তিহীনতায় ভরা দর্শন। বৈদিক যুগের ধর্মগুরুরা মাধমিক দর্শনের যুক্তিমনস্কতাকে ভয় পেয়েছিলেন। তারই পরিণতিতে মাধ্যমিকদের একঘরে করার চেষ্টায় মেতেছিলেন। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এমন কিছু গভীর ও সূক্ষ্ম চিন্তার মানুষ ছিলেন- ভাবলে বিষ্ময় জাগে।



২. যোগাচার
গাচারযোগাচারও একটি মহাযান বৌদ্ধ দর্শন। যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদ এর মতে - চৈতন্য, চেতনা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান নিজে থেকেই ক্রিয়াশীল। বাইরের কোনও শক্তির দ্বারাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি।


যোগাচার দর্শনে এমন বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তার পাশাপাশি কিছু ভ্রান্তিও ছিল। যোগাচারীরা মাধ্যমিকদের মতই মনে করতেন - যেহেতু চৈতন্য ছাড়া আমরা কোনও কিছুই দেখতে পারিনা, জানতে পারি না, তাই দৃশ্যমান কোন বস্তুর বাস্তব অস্তিত্ব নেই।



৩. সৌত্রান্তিক
সৌত্রান্তিকপন্থীরা নিরীশ্বরবাদী। তাঁরা মনে করেন, ঈশ্বর নেই। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড, প্রকৃতির কোনও কিছুই ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। সব কাজের পিছনেই থাকে কারনের বিবর্তনমূলক প্রকৃয়া। মাটিতে বীজ পুঁতলে অংকুর হয়। অংকুর থেকে শিশু গাছ, কাণ্ড-শাখা-প্রশাখা-পাতা-ফুল-ফল সবই একটা কারনের বিবর্তনমূলক প্রকৃয়া। সৃষ্টি স্থান-কাল নির্ভর। একটা বীজকে মাটিতে বপন না করে মাটি বা ধাতুর পাত্রে রেখে দিলে মাটি ও জলের অভাবে বীজ থেকে অঙ্কুর সৃষ্টি হবে না। মৈথুএর এক পক্ষের মধ্যে জন্মও নেবে না একজন শিশু। নারি-পুরুষের মিলন থেকে সকল শিশুর জন্মানোর যে বিবর্তন প্রক্রিয়া,তার জন্য একটা নির্দিষ্ট কালের প্রয়োজন। ঈশ্বর এই স্থান-কালের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সৃষ্টি করতে পারে না। সৌত্রান্তিক্রা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ প্রমাণকে গ্রহণ করতেন না।অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রত্যক্ষপ্রমাণকে মিলিয়ে বিচার করলে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় বলে মনে করতেন। হীনযানী বৌদ্ধদেরই একটি সম্প্রদায়ের নাম হল সৌত্রান্তিক।



৪. বৈভাষিক
হীনযানী বৌদ্ধদেরই আরও একটি শাখা বৈভাষিক। বৈভাষিকদের মতে গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধত্ব প্রাপ্তির পর যে'সব উপদেশ দিয়েছিলেন, সেগুলি নিয়েই সাতটি অভিধর্ম গ্রন্থ। এই অভিধর্ম গ্রন্থই বৌদ্ধদর্শনের প্রামাণ্য উৎসগ্রন্থ।


বৈভাষিকরা প্রত্যক্ষপ্রমাণকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। মনে করতেন সমস্ত বস্তু চারটি ভূত দ্বারা গঠিত। এরা হল, পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু। বৈভাষিকরা ন্যায়বৈশেষিকদের পারমাণবিক তত্ত্বকে স্বীকার করতেন।


বৈভাষিক দর্শনে বলা হয়েছে, পরমাণুর ছয়টি কোণ আছে। বস্তুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, অবিভাজ্য বিশ্লেষণ অযোগ্য অ অস্থির চরিত্র হল পরমাণুর গুণ। এককভাবে অদৃষ্য হলেও সমষ্টিগতভাবে দৃশ্যমান।


বৈভাষিকরা নিরীশ্বরবাদী। এমন নিরীশ্বরবাদীদের পরবর্তী জন্মও শেয়াল যোনিতে হবে বলে বৈদিক পূজারীরা গালি দিলেও, সেটা আদৌ অস্বাভাবিক ঠেকে না। বাঁচোয়া- শকুনের অভিশাপে গরু মরে না।



৫. চার্বাক
চার্বাক দর্শন একটু বৃহৎ আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে সেটাকে এখানে আলোচিত না করে আলাদাভাবে আলোচিত করা হয়েছে। চার্বাক মতবাদ সম্পর্কে জানতে নিচের নিবন্ধগুলো পড়তে পারেন-

চার্বাক মতবাদ - ১ - http://www.facebook.com/note.php?note_id=10150209618089561
চার্বাক মতবাদ - ২ - http://www.facebook.com/note.php?note_id=10150212369704561
অথবা,
চার্বাক মতবাদ - http://sumitroydipto.blogspot.com/2011/06/blog-post_03.html



৬. দিগম্বর
মহাবীরের দিগম্বর মতবাদ সম্পর্কেও আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়েছে। নিচে উল্লিখিত নিবন্ধটি দেখুন-

মহাবিরের দিগম্বর মতবাদ - http://www.facebook.com/note.php?note_id=10150219224724561
অথবা,
মহাবিরের দিগম্বর মতবাদ - http://sumitroydipto.blogspot.com/2011/06/blog-post_04.html



এতক্ষন যেসব নাস্তিক্যবাদী মতবাদ বৈদিক সাহিত্যে উল্লিখিত হয়েছে সেসব মতবাদ নিয়ে আলোচনা করলাম। এখন অন্যান্য মতবাদগুলো নিয়ে আলোচনা করব। তার আগে কিছু গুরুত্বপুর্ণ কথা বলে রাখি। প্রাচীন ভারতীয় দর্শন বলতে যে চিন্তাধারা বোঝায়, তা প্রধানত নিরিশ্বরবাদী। কথাটা একটু নতুন শোনালেও এটাই সত্যি, একশো শতাংশ সত্যি।


আমরা খবরের কাগজ পড়ে ততটাই জানতে পারি যেটুকু ছাপানো হয়, চাপা খবর আমরা পাই না। ঠিক তেমনই বেশির ভাগ ভারতীয় দার্শনিক প্রাচীন ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে যতটা ছেপেছেন, তার চেয়ে বেশি চেপেছেন।


ম্যাক্সমুলার থেকে রাধাকৃষ্ণ, ভারতীয় দর্শনের গবেষক থেকে প্রামাণ্য দার্শণিকেরা বলতে চেয়েছেন, হিন্দু ধর্ম মূলত একেশ্বরবাদী। তারা দেখাতে চেয়েছেন, বেদের দেবতারা ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিনিধি বা প্রতীক। পরবর্তিকালে বেদ বিশ্বাসী মানুষরা বুঝেছিলেন, সমস্ত শক্তির উৎস এক। তিনিই পরম ব্রহ্ম, ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুর নিয়ন্তা।


এইসব ভারত বিশেষজ্ঞ, পণ্ডিত, দার্শনিকেরা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে, ব্রিটিশ শক্তির পরিমণ্ডলে পরিপক্ক হওয়ার ফলে খ্রিষ্টীয় একেশ্বরবাদের সাংস্কৃতিক শাসনকে মেনে নিয়েছিলেন। বৈদিক ধর্মের যাগযজ্ঞ সর্বস্বতাকে, বহু ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসকে, খ্রিস্ট্রীয় একেশ্বরবাদের তুলনায় হীন বলে মনে করেছিলেন। ফলে বৈদিক ধর্মকে মূলত একেশ্বরবাদী বলে প্রচার করতে চেয়েছিলেন। আর এই চাওয়াকে সার্থক করতে এইসব তথাকথিত পণ্ডিতেরা ইতিহাস বিকৃত করতে চেষ্টার কসুর করেননি।


মুশকিল হল, বৈদিক সাহিত্য একেশ্বরবাদী তো নয়-ই, এমনকী ঈশ্বরকে সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা বলে মনে করে না। বেদ দ্বিধাহীন ভাবে মনে করে, যে কারণে যজ্ঞ করা হবে, সে ফল মিলবেই। ঈশ্বরের ক্ষমতা নেই এই ফল লাভ আটকে দেবার। ক্ষমতা নেই ফল দেবার। যজ্ঞই একমাত্র সত্য। দেবতার ভুমিকা শুণ্য। বেদে যজ্ঞের ভূমিকার প্রাধান্য দেবার একটা বিশেষ কারনও আছে বটে। সবাই যদি মনে করে যে সকল অভিষ্টপূরণকারী হল দেবতা আর সেই দেবতাকেই উপাসনা করায় সবাই ব্যাস্ত হয়ে পরে তাহলে ব্রাহ্মণদের পেট কী করে চলবে? কারণ তখনকার সময় ব্রাহ্মণদের জীবিকাই ছিল এইসব যাজ্ঞের উপর নির্ভরশীল। তাই নিজেদের পেট চালানোর জন্য ব্রাহ্মণেরা বেদে যজ্ঞের বিধান দেন এবং দেবতাদের ভূমিকাকে কমিয়ে দিয়ে নিজেদের জীবিকা নিশ্চিত করেন। পাঠকগণ, আশা করি ইতিমধ্যে আপনারা সকলে বুঝে গেছেন যে ধর্মগুরুদের ধ্যানলব্ধ জ্ঞানের দ্বারা নয় বরং ধর্মগুরুদের পেটের তাগিদেই পরিকল্পিতভাবে হিন্দুধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল আর তারপর বিভিন্নভাবে সমাজকে আয়ত্তে আনার চেষ্টায় এই হয়েছে এই ধর্মের বিবর্তন।


যাইহোক এখন মূল আলোচনায় আসি। বেদে অনুল্লিখিত প্রাচীন ভারতের নিরীশ্বরবাদী মতবাদগুলো সম্পর্কে নিম্নে উল্লেখ করা হল -



সাংখ্য
সাংখ্য দর্শনকে ভারতের প্রাচীনতম দর্শন বলে মনে করেন ভারতীয় দার্শনিকরা। সাংখ্য দর্শন নিরিশ্বরবাদী দর্শন। এখানেই শেষ নয়। সাংখ্য দর্শন মূলত বস্তুবাদী দর্শন। সাংখ্য যে একটি প্রাচীন মতবাদ, তার প্রমাণ- উপনিষদ সমূহে ও মহাভারতে সাংখ্য দর্শনের উল্লেখ আছে। গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগের পর সাংখ্য অধ্যয়ন করেছিলেন বলে মনে করা হয়। কারণ সাংখ্য দার্শনিক কপিল ছিলেন বুদ্ধের উত্তরসুরী এবং বৌদ্ধ ধর্মের উপর সাংখ্যের প্রভাব স্পষ্ট।


কপিল তার সাংখ্যে ব্রহ্ম বা পরমাত্মাকে কোনও স্থান দেননি। তার মতে প্রকৃতি নিত্য, সমস্ত জাগতিক পদার্থ তারই পরিবর্তনের ফলে উৎপন্ন।


সাংখ্য মনে করে- জড় প্রকৃতির বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বিশ্বের সব কিছুর সৃষ্টি। প্রতিটি কাজ বা ঘতনার পিছনেই রয়েছে কারণ। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ সাংখ্য-সংস্থাপক কপিলকে ঋষি বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। নিরীশ্বরবাদী কপিল মুনি হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছে ঈশ্বরের পরমভক্ত মুনি হিসেবে পুজিত হচ্ছেন- এটাই দুঃখ। ইতিহাস বিকৃতিকে দেখার দুঃখ। প্রচারের দৌলতে বিকৃতিকারীদের আলোকিত হতে দেখার দুঃখ।



মীমাংসা
ভারতবর্ষের আরও একটি প্রাচীন ও অত্যন্ত শক্তিশালী দর্শন হল মীমাংসা। মীমাংসাবাদীরা স্পষ্টতই নিরীশ্বরবাদী। মীমাংসক কুমারিল ভট্টের রচিত শ্লোকবাতিক থেকে মীমাংসা দর্শনের কিছু মতামত তুলে ধরছি-


১. কেউ যদি বলেন এই বিষ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে থেকেই ঈশ্বর ছিলেন, তবে তাকে প্রশ্ন করা যেতে পারে সৃষ্টি না থাকলে স্থান থাকে না। স্থান না থাকলে ইশ্বর কোন স্থানে থাকতেন?


২. ঈশ্বর নিরাকার ছিলেন, নাকি তার আকার ছিল, দেহ ছিল? দেহ থাকলে সেই দেহের নিশ্চই একজন স্রষ্টা ছিলেন?


৩. ঈশ্বর সৃষ্টির জন্য নিশ্চই আর একজন ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়েছিল। সেই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করতে আরও একজন ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়েছিল। এভাবে অনন্ত ঈশ্বরের প্রয়োজন হতেই থাকবে।


৪. কোন উপাদান দিয়ে তিনি বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন? সেই উপাদানগুলো কি সৃষ্টির আগে থেকেই বর্তমান ছিল? থাকলে সেগুলো কোথায় ছিল?


৫. সৃষ্টির উপাদান গুলোর স্রষ্টা কে?


৬. যদি ঈশ্বর তার দেহ থেকেই এই উপাদান তৈরি করে থাকে- তবুও প্রশ্ন থেকে যায় সেই দেহের স্রষ্টা কে? স্রষ্টা হিসেবে একের পর এক ঈশ্বর আনলেও এর উত্তর পাওয়া যাবে না।


৭. ইশ্বর কেন জগৎ সৃষ্টি করলেন? কী অভাববোধ থেকে এই সৃষ্টি? ঈশ্বরের অভাববোধ থাকার অর্থ তিনি পূর্ণ নন।


৮. এই সৃষ্টিকে ঈশ্বরের লীলা বললে, বলতেই হয় ঈশ্বর দায়িত্বজ্ঞানহীন।


৯. ঈশ্বর যদি করুণা থেকে জগৎ সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে জগতে কেন এত দুঃখ?


১০. বেদ এ'কথাই বলে যে, বাঞ্ছিত ফল পেতে যজ্ঞই একমাত্র সত্য, দেবতার কোনও ভূমিকা নেই। দেবতা ফল দিতেও পারে না, ফল লাভ বন্ধও করতে পারে না। বোইদিক যজ্ঞ নীত 'ব্রাহ্মণ' তার প্রমাণ। তাহলে দেবতা বা ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নন।


পাঠকেরা, আমার মনে হয় উপরে যা যা বললাম তাতে মীমাংসা দর্শন তদকালীন ব্রাহ্মণ্যবাদী দলের কাছে কী ভয়ানক চীজ ছিল সে বিষয়ে আপনাদের বুঝতে আর বাকি নেই। ঈশ্বর বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে এমন ভয়ংকর আক্রমণ আর কোনও দর্শনই হানতে পারেনি। সত্যি বলতে কী, এ'যুগের উচ্চডিগ্রিধারী অনেকের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন মীমাংসাবাদীরা। মজার কথা হল, প্রচারের আলোয় আলোকিত বিখ্যাত পণ্ডিতদের শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে হয়েছে যে, সাংখ্য এবং মীমাংসা নিরীশ্বরবাদী মতবাদ ও মূলত বস্তুবাদী মতবাদ।



স্বভাববাদ
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের যুগে আরও একটি যুক্তিমনষ্ক মতবাদ উঠে এসেছিল। মতবাদটির নাম স্বভাববাদ। স্বভাববাদের উল্লেখ আমরা পাই মহাভারতে, বৌদ্ধ লংকাবতার সূত্রে ও অশ্বঘোষের বুদ্ধ চরিত-এ। স্বভাববাদ স্পষ্টতই একটি যুক্তিমনষ্ক মতবাদ। এই মতবাদ অনুসারে-

১. বিষ্বপ্রকৃতি কার্য-কারণের নিয়মশৃঙ্খলে বাঁধা।
২. একটি বিশেষ ধরণের ঘটনার পেছনে একটি বিশেষ ধরণের কারণ থাকে। যেমন, মাটি থেকে মৃতপাত্র-ই হত পারে, পরিধেও বস্ত্র নয়।
৩. কারণহীন বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়।
স্বভাববাদীরা ছিলেন অতিপ্রাকৃতে অবিশ্বাসী, নিরীশ্বরবাদী।



বৌদ্ধ মতবাদ
বোউদ্ধ মতবাদ নিয়ে লিখতে গেলে প্রাসংগিক অনেক কিছুই লিখতে হয়। তাই আয়তনের বিশালতার কারণে আলাদাভাবে বৌদ্ধ মতবাদ নিয়ে লেখা হল। নিচে নিবন্ধটির লিঙ্ক দেয়া হল-

বৌদ্ধ মতবাদ - ১ - http://www.facebook.com/note.php?note_id=10150206453329561
বৌদ্ধ মতবাদ - ২ - http://www.facebook.com/note.php?note_id=10150206465459561
অথবা,
বৌদ্ধ মতবাদ - http://sumitroydipto.blogspot.com/2011/06/blog-post_4264.html





নারী-খৎনা : একটি বর্বরোচিত ধর্মীয় প্রথা


মুসলিম দুনিয়ার বহু দেশেই নারী খৎনা নামের এক বীভৎস, বর্বরোচিত ধর্মীয় প্রথা প্রচলিত রয়েছে । এই প্রথা মনুষ্যসমাজের কলঙ্ক বই কিছুই নয় । এই প্রথা পুরুষকে মানুষ থেকে শয়তানে পরিণত করেছে । আর নারীকে পরিণত করেছে পশুতর জীবে ।


এই প্রথা আজও প্রচলিত আছে ঘানা, গিনি, সোমালিয়া, কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া, নাইজেরিয়া, মিশর, সুদান সহ উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশে । এই সব দেশে নারীদের যৌন কামনাকে অবদমিত করে যৌন-আবেগহীন যৌন-যন্ত্র করে রাখতে পুরুষশাশিত সমাজ বালিকাদের ভগাঙ্কুর ( clitorich) কেটে ফেলে । নারীর যৌন-আবেগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় যোনির প্রবেশ মুখে পাপড়ির মত বিকশিত ভগাঙ্কুর । নারীদের খৎনা করা হয় ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার আগে অর্থাৎ সাধারণত সাত-আট বছর বয়সে । খৎনা যারা করে তাদের বলা হয় হাজামী । দু'জন নারী শক্ত করে টেনে ধরে বালিকার দুই উরু । দু'জন নারী চেপে ধরে বালিকার দুই হাত । হাজামী ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে ভগাঙ্কুর । এই সময় উপস্থিত নারীরা সুর করে গাইতে থাকেন, ''আল্লাহ মহান, মুহম্মাদ তার নবী; আল্লাহ আমাদের দূরে রাখুক সমস্ত পাপ থেকে ।"

পুরুষশাসিত সমাজ ওই সব অঞ্চলের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের রন্ধ্রে রন্ধ্রেই বিশ্বাসের বীজ রোপন করেছে, কাম নারীদের পাপ, পুরুষদের পূণ্য । খৎনার পর সেলাই করে দেওয়া হয় ঋতুস্রাবের জন্য সামান্য ফাঁক রেখে যোনিমুখ । খোলা থাকে মূত্রমুখ । খৎনার পর চল্লিশ দিন পর্যন্ত বালিকার দুই উরুকে একত্রিত করে বেঁধে রাখা হয়, যাতে যোনিমুখ ভাল মত জুরে যেতে পারে । বিয়ের পর সেলাই কেটে যোনিমুখ ফাঁক করা হয়, স্বামীর কামকে তৃপ্ত করার জন্য । আবারো বলি, স্বামীর কামকে তৃপ্ত করার জন্যই; কারণ নারীর কাম তো ওরা পাপ বলে চিহ্নিত করে নারীকে করতে চেয়েছে কাম গন্ধহীন যৌন-যন্ত্র । সন্তান প্রসবের সময় সেলাই আরো কাটা হয় । প্রসব শেষেই আবার সেলাই । তালাক পেলে বা বিধবা হলে আবার নতুন করে আবার নতুন করে সেলাই পড়ে ঋতুস্রাবের জন্য সামান্য ফাঁক রেখে । আবার বিয়ে, আবার কেটে ফাঁক করা হয় যোনি । জন্তুর চেয়েও অবহেলা ও লাঞ্ছনা মানুষকে যে বিধান দেয়, সে বিধান কখনই মানুষের বিধান হতে পারে না । এ তো শুধু নারীর অপমান নয়, এ মনুষ্যত্বের অবমাননা ।

মহাবীরের দিগম্বর মতবাদ

জৈন ধর্মের দু'টি ভাগ। একটি শ্বেতাম্বর, দ্বিতীয়টি দিগম্বর। জৈন মত অনুসারে চব্বিশজন তীর্থংকর জৈন ধর্মের বিকাশ ঘটিয়েছিল। প্রথম তীর্থংকরের নাম ঋষভ বা আদিনাথ। পরবর্তী তীর্থংকররা হলেন : অর্জিত, সম্ভব, অভিনন্দ, সুমতি, পদ্মপ্রভ, সুপার্শ্ব, চন্দ্রপ্রভ, সুবিধি,শীতল, শ্রেয়াংশ, বসুপুজ্য, বিমল, অনন্ত, ধর্ম, শান্তি, কুন্‌থ, আর, মল্লি, মুনিসুব্রত, নমি, অরিষ্টনেমি, পার্শ্ব বা পার্শ্বনাথ অথবা পরেশনাথ ও মহাবীর। মহাবীর হলেন চব্বিশতম তীর্থংকর।



এক থেকে বাইশতম তীর্থংকরকে নিয়ে এত বেশি অতিরঞ্জন ও অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি যে, ঐতিহাসিকদের ধারণা এ'গুলো কল্পকাহিনী। এতে এমনটা হতে মনে হতেই পারে যে, এইসব তীর্থংকরদের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ভক্তির প্রাবল্যে এদের চরিত্রগুলোকে ভক্তরা বেশি রকম বড় করতে গিয়ে অবাস্তব করে তুলেছেন।



তীর্থংকর হিসেবে পার্শ্ব বা পার্শ্বনাথই প্রথম, যার অস্তিত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। জৈন মত অনুসারে পার্শ্বনাথের জন্মও আনুমানিক ৮১৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। পিতা অশ্বসেন ছিলেন গোষ্ঠীপতি। এক গোষ্ঠীপতির কন্যার সঙ্গে পার্শ্বনাথের বিয়ে হয়।



মানুষের জীবনের নানা দুঃখ দেখে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে তিরিশ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন। এদিক থেকে পার্শ্বনাথের সঙ্গে বুদ্ধের কিছু মিল আমরা পাই। পার্শ্বনাথের দুঃখ চেতনা ছিল জাগতিক, বুদ্ধের মত।



সত্যকে জানতে, দুঃখের কারণ জানতে তিরিশ দিন ধরে নিজেকে সমাজ-সংসার থেকে দূরে রেখে গভীর চিন্তায় ডুবিয়ে রাখেন। শেষে দুঃখের কারণ ও তার থেকে অব্যাহতির উপায় খুঁজে পান। সত্তর বছর ধরে তার মতাদর্শ প্রচার করেন। একশো বছর বয়সে মৃত্যু।




পার্শ্বনাথের চার নীতি বা চতুর্যাম

পার্শ্বনাথ তার প্রচারিত ধর্মে 'চতুর্যাম' অর্থাৎ চারটি নীতি বা ব্রতর কথা বলেছিলেন।

১. অহিংসা - কারও জীবননাশ করবে না।

২. অনৃত - মিথ্যে বলবে না। কারও বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ আনবে না।

৩. অস্তেয় - চুরি করবে না। চোরদের কাছ থেকে কোন জিনিস কিনবে না। ক্রেতাকে মিথ্যে ওজনে জিনিস বিক্রি করবে না। দ্রব্যে ভেজাল দেবে না।

৪. অপরিগ্রহ - ব্যক্তিগত জমিজমা - ভূসম্পত্তির অধিকারি হবে না।




মহাবীর

চব্বিশতম তীর্থংকর মহাবীর জৈনদের দিগম্বর সম্প্রদায়ের স্রষ্টা। নগ্নতাবাদী মহাবীরের জন্মও আনুমানিক ৫৯৯ বা ৫৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। জন্মও বৈশালীর বসুকুণ্ড গ্রামে ( বর্তমান মজঃফরপুর, বিহার ।). পিতা সিদ্ধার্থ ছিলেন একটি উপজাতির গোষ্ঠীপতি। জৈন শ্বেতাম্বরপন্থীদের মতে মহাবীরের একটিই মেয়ে - অনুজা।

দিগম্বর থেকে মহাবির ছিলেন চিরকুমার ও কঠোর ব্রহ্মচারী। তিরিশ বছর বয়সে তার বিপুল সম্পত্তি দান করে দিয়ে গ্রিহত্যাগ করেন ও পরিব্রাজক বৃত্তি গ্রহণ করেন। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে চেয়েছিলেন দুঃখের কারণ ও দুঃখময় জগৎ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে।



পরিব্রাজক জীবনে তিনি কোন গ্রামে এক রাতের বেশি থাকতেন না। এভাবে তের মাস কেটে যাওয়ার পর কাপড় পরিধান করা ছেড়ে দেন। মহাবীর দিগম্বর থাকার কারণে নানা জায়গায় খারাপ ব্যবহার পেয়েছেন।



পরিব্রাজক জীবনের তৃতীয় বছরে তিনি আর এক চিন্তাবিদ গোশাল মংখলিপুত্তের সঙ্গে পরিচিত হন। দুজনে মত বিনিময় ও চিন্তা বিনিময়ের মধ্যে ছয় বছর কাটিয়ে দেন। তারপর মত পার্থক্যের কারনে দুজনের বিচ্ছেদ হয়। গোশাল নিজেকে তীর্থংকর ঘোষণা করেন এবং তীর্থংকর মহাবীরকে ত্যাগ করেন।



দীর্ঘ বার বছরের পরিব্রাজক জীবনে তিনি মগ্ন হয়ে শীত-গ্রীষ্মের তাপের কষ্ট পেয়েছেন। নগ্নতার কারনে ভিক্ষেও জোটেনি। দীর্ঘ দিন কেটেছে অনশনে, মানুষের ও কুকুরের তারা খেয়ে। শরীরকে এমনভাবে কষ্ট দেয়ার কারণ, মহাবীর এই সময় মনে করতেন দুঃখভোগই পাপস্খালন এবং মুক্তির উপায়।



ঋজুপালিকা নদীর তিরে জৃনভিকা গ্রামে একটা শালগাছের নিচে বসে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উপলব্ধিতে পৌঁছন বা জ্ঞান লাভ করেন। এরপর ধর্ম প্রচারে বের হন। মহাবীরের মামা বৃজি উপজাতির গোষ্ঠীর প্রধান চেটক ছিলেন মহাবীরের পৃষ্ঠপোষক। অজাতশত্রু মগধরাজ থেকে কৌশাম্বীর রাজা স্থানক মহাবীরকে সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানান।



জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে উপদেশ প্রচার করে বেরিয়েছিলেন। ৮৪ বছর বয়সে তিনি পাবা'য় (বর্তমান গরক্ষপুর) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মহাবীর ছিলেন বুদ্ধের সমসাময়িক। ছিলেন অত্যন্ত ভাল সংগঠক। জৈন সংঘকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।



মহাবীর বৈদিক যুগের সমসাময়িক ছিলেন। বেদকে অভ্রান্ত মনে করতেন না। তিনি ছিলেন নিরীশ্বরবাদী নাস্তিক, অলৌকিকে অবিশ্বাসী, নিয়তিবাদে অবিশ্বাসী। আপেক্ষিক গুণবাদ বা 'স্যাদ্‌বাদ'-এ বিশ্বাসী ছিলেন।




পঞ্চব্রত

মহাবীর চতুর্যামের পরিবর্তে 'পঞ্চব্রত' বা পাঁচটি নীতির কথা বলেছিলেন। পার্শ্বনাথের নিতগুলো সরিয়ে তিনি নতুন কিছু নীতির প্রবর্তন করেন নি। চতুর্যামের চারটি নীতির সঙ্গে একটি নতুন নীতি যুক্ত করেছিলেন। নীতিটি হল ব্রহ্মচর্য। 'ব্রহ্মচর্য' বলতে শুধু সহবাস থেকে বিরত থাকা বোঝায় না, সমস্ত ইন্দ্রিয়ভোগ থেকে বিরত থাকা বোঝায়।

এই পঞ্চব্রতকে আবার মহাবীর দু'ভাগে ভাগ করেছিলেন। ১. অনুব্রত ও ২. মহাব্রত। গৃহী জৈনদের জন্য নরম করে তৈরি হয়েছিল অনুব্রত । গৃহীদের পক্ষে 'অহিংসা' বলতে বলা হয়েছে- উদ্ভিদজাতীয় প্রাণির উর্ধ্বতন যেসব প্রাণী, তাদে৪র প্রতি অহিংসা ব্রত পালন করতে হবে। 'ব্রহ্মচর্য' বলতে বলেছেন, গৃহীদের একপত্নী ব্রত পালনের কথা।

শ্রমণদের বেলায় 'ব্রহ্মচর্য' আবশ্যিক শর্ত। দিগম্বরপন্থীরা মনে করেন শ্রমণ বা জৈন সন্ন্যাসীদের অবশ্যই সমস্ত পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে হবে, নগ্ন থাকতে হবে। দিগম্বরপন্থীরাও আরও মনে করেন, তীর্থংকররা প্রত্যেকেই পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েই জ্ঞানের সাধনা করেছিলেন। জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সুতরাং তীর্থংকরদের ছবি আঁকতে হলে নগ্নই আঁকতে হবে, মূর্তি-খোদিত হলে, তা হবে নগ্ন। কাপড় পরিয়ে সভ্য সাজাবার প্রয়াস মিথ্যাকে সত্যি বলে প্রচার ছাড়া কিছু নয়। এই ধরণের মিথ্যাচারিতা 'অনৃত' বা সত্য নীতিকে লঙ্ঘন করা।



জৈন দার্শনিকদের মধ্যে পরমাণু সম্পর্কে ধারণা ছিল। উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জয়োতির্বিদ্যার উন্নতির ক্ষেত্রে জৈন দার্শনিকদের অবদান অনস্বীকার্য।

জৈন ধর্মের প্রধান সংগঠক চিলেন দিগম্বরবাদী মহাবীর। তাই বৈদিক যুগের পুরোহিত সম্প্রদায়ের তীব্র ক্ষোভ দিগম্বরদের উপর ছিল। ঈশ্বর নেই, মানে ঈশ্বর উপাসনা, যাগ-যজ্ঞ, হোম, বলি, পুরোহিতদের প্রণামী দেয়া সবই অর্থহীন। এতো দস্তুরমতো বৈদিক পুরোহিতদের অস্তিত্বের সংকট! এই সংকট কাটাতে পুরোহিতরা নিরীশ্বরবাদীদের উপর খড়্গহস্ত ছিলেন। এমনকী নিরীশ্বরবাদীদের ঝাড়ে-বংশে নির্মূল করতে আক্ষরিক অর্থেই অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন হাতে।




দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর বিরোধ

জৈন ধর্ম প্রধানত নীতি-ধর্ম। জৈন ধর্ম মহাবীরের সময় দুটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়। ১. দিগম্বর ও ২. শ্বেতাম্বর। দিগম্বররা শরীরে কোন কাপড় রাখেন না। তারা নগ্নতাবাদী ও প্রকৃতিবাদী। শ্বেতাম্বররা সাদা কাপড় পরেন। শ্বেতাম্বররা মনে করেন জৈন ধর্মের পবারটি প্রাচীন 'অঙ্গ' গ্রন্থ আছে। এই বারটি অঙ্গ নামের গ্রন্থ ছাড়াও 'উপাঙ্গ' নামে আরো বারটি ধর্মগ্রন্থ আছে। অঙ্গ ও উপাঙ্গ ছাড়াও আরও কিছু গ্রন্থকে শ্বেতাম্বররা জৈন ধর্মের অন্তর্গত বলে মনে করেন।



দিগম্বরপন্থীরা মহাবীরের সময়ের আগে লেখা কোনও জৈন-গ্রন্থকেই প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে না। দিগম্বরপন্থীদের কিছু ধর্মীয় গ্রন্থ আছে যেগুলো চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত। সেসব গ্রন্থ মহাবীরের সময়ে ও পরবর্তীকালে লেখা।



পার্শ্বনাথের চতুর্যাম শ্বেতাম্বররা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেন। দিগম্বররা মানেন মহাবীরের পঞ্চব্রত। দিগম্বররা কিছুটা কট্টরপন্থী। তারা মনে করেন, ১. নারীরা মোক্ষ লাভের অধিকারী নয়। ২. চিত্রে বা মূর্তিতে তির্থংকরদের নগ্ন রাখতে হবে, চোখ থাকবে মুদ্রিত। ৩. জৈন শ্রমণ অর্থাৎ জৈন সাধুদের নগ্ন থাকতে হবে। ৪. প্রকৃত জ্ঞানীদের কোন খাদ্যগ্রহণের প্রয়োজন হয় না, যেমন হয়নি মহাবীরের। ৫. মহাবীরই শেষ প্রকৃতজ্ঞানী বা তীর্থংকর। ৬.সব শাস্ত্র ও ধর্মীয় গ্রন্থই মানুষের লেখা, তাই চিরন্তন বা শাশ্বত নয়। এই শেষ বক্তব্যের মধ্যে বেদকে অস্বীকার করা হয়েছে স্পষ্টভাবে।



জৈনদের এই দুটি ভাগ আবার পরবর্তীকালে আরও কিছু উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। শ্বেতাম্বররা তিনটি উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত- মূর্তিপূজক, তেরপন্থী ও স্থানকবাসী। উত্তরভারতে শ্বেতাম্বরদের প্রাধান্য রয়েছে। দিগম্বররা পাঁচটি উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত। এরা হল- বীসপন্থী, তেরপন্থী, তোতাপন্থী, তারণপন্থী এবং গুনামপন্থী। দক্ষিণভারতে এদেরই প্রাধান্য। ভারতে সামগ্রিকভাবে শ্বেতাম্বরপন্থীদের-ই স্পষ্ট প্রাধান্য রয়েছে।




স্যাদ্‌বাদ বা আপেক্ষিক গুণবাদ

জৈন্রাই প্রথম 'আপেক্ষিক গুণবাদ' বা স্যাদ্‌বাদের কথা বলল। এই মতবাদের মূল কথা- কেউ যখন কোন বস্তুর বর্ণনা দেয়, তখন সে তার ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে দেয়। বস্তুর এই বর্ণনা তখনকার মত সত্য হলেও নিত্য নয়। স্যাদবাদে ছয় অন্ধের হাতি দেখার কথা বলা হয়েছে। একই হাতি কারও কাছে দড়ির মতো, কারোর কাছে গুঁড়ির মতো, কারও কাছে বা সাপের মতো। এসবই আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ সত্য নয়।



ভোরের সূর্য ও গোধূলির সূর্য লাল টুকটুকে। দুপুরের সূর্য যখন মধ্য আকাশে, তখন সে আগুনের গোলা। এসবই সত্যি। সময়ের সঙ্গে সত্যিটা পালটে যায়, যাকে বলে আপেক্ষিক গুণ। আপেক্ষিক গুণ সংক্রান্ত মতবাদই স্যাদবাদ। যুক্তিবাদের একটি সিদ্ধান্ত আমরা দেখতে পাই স্যাদবাদে।




মোক্ষ

জৈন মাত্রেই নিরীশ্বরবাদী। জৈন ধর্মগ্রন্থের লেখকেরা ঈশ্বর ধারণাকে খণ্ডন করেছিলেন। জৈনরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না বটে, কিন্তু দেবতায় বিষ্বাস করে। জৈন ধর্মে দেবতা ও ঈশ্বরের সংজ্ঞায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। জৈনরা গুণের প্রতিককে 'দেবতা' বলে। দেবতার কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নেই। পার্থিব কোনও কিছু দেবার ক্ষমতা নেই। মানুষ সাধনার মধ্য দিয়ে দেবতা হতে পারে।



বৌদ্ধদের একাধিক সম্প্রদ্য মনে করে, যে কেউ সাধনার দ্বারা বৌদ্ধত্ব লাভ করতে পারে, বুদ্ধ হতে পারে। জৈনদের 'দেবতা' ধারনা অনেকটা এইরকম। তারা মনে করে, সাধনা ও জ্ঞানার্জনের ফল হিসেবে পরজন্মে মানুষ দেবতা হওয়া যায়। এই দেবতারা জন্ম-মৃত্যুর অধীন। দেবতা জন্মে খারাপ কাজ করলে পরজন্মে কীট হয়ে জন্মাতে হবে। অর্থাৎ জৈনরা পরজন্মে বিশ্বাসী।



দেবতা হওয়ার উপায় কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি। মুক্তির জন্য জরুরি ১. সম্যক জ্ঞান, ২. সম্যক দর্শন, ৩.সম্যক চরিত্র। দেবত্ব লাভ বা মোক্ষ লাভের এই তিন আবশিক শর্তকে বলে 'রত্নত্রয়'।



'সম্যক জ্ঞান' বলতে জৈন ধর্ম বিষয়ে বিস্তৃত জ্ঞান ও স্বচ্ছ বা স্পষ্ট জ্ঞানকে নির্দেশ করা হয়েছে।

'সম্যক দর্শন' অর্থে জৈন ধর্মের নীতিতে অবিচল থাকার কথা বলা হয়েছে।

'সম্যক চরিত্র' বলতে জৈন ধর্মের নীতি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে।




জৈন সংঘ

জৈন সংঘ ও বৌদ্ধ সংঘের আদর্শ মোটামুটি একই। আদিম উপজাতি সম্প্রদায়ের মত জৈন সংঘেও ব্যক্তিগত আপত্তি বলে কিছু ছিল না। শ্রমণদের সমস্ত রকমের জাগতিক ইন্দ্রিয়সুখকে বর্জন করতে হত। আহার ও শয্যা বিষয়ে কোন মতামত প্রকাশ ধর্মচ্যুতি হিসেবে গণ্য হত।



জৈন ধর্মের বিকাশ ভারতবর্ষের বাইরে কোথাও হয় নি। ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে জৈন ধর্মের মানুষেরা সংখ্যায় অনেক।




অণু-পরমাণু বা 'পুদ্‌গল'

জোইন দার্শনিকদের মধ্যে পরমাণু সম্পর্কে ধারণা ছিল। জৈন দার্শনিকরা বললেন, স্থুল জড়বস্তুকে ভাঙ্গা যায়। ভাঙতে ভাঙতে এমন একটা ক্ষুদ্রতম অংশে পৌঁছায়, যখন আর ভাঙ্গা সম্ভব নয়। জড়ের বা 'পুদ্‌গল' এর এই অবিভাজ্য সূক্ষ্ম কণাকে 'অণু' বলে। অণুই জড় জগতের মৌলিক উপাদান।



জৈন পরমাণুবাদের সঙ্গে ন্যায়বৈশেষিকদের পরমাণুবাদের গুণগত পার্থক্য আছে। ন্যায়বৈশেষিক মতে পরমাণুদের মধ্যে আবার গুণগত পার্থক্য আছে। জৈন মতে পরমাণুদের মধ্যে গুণগত কোন পার্থক্য নেই। প্রতিটি পরমাণু সমগুণদম্পন্ন। উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিতসা-বিজ্ঞান ও জ্যোটির্বিদ্যার উন্নতির ক্ষেত্রে জৈন দার্শনিকদের অবদান অনস্বীকার্য।




জৈন ও বণিক সম্প্রদায়

জৈন ধর্ম মূলত নীতিমূলক ধর্ম। এই ধর্মে অহিংসাকে বেশি রকম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অজ্ঞান্তসারে একটি পোকাকে হত্যা করলেও তা পাপ। জৈনদের অনেকেই এক টুকরা সাদা কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখে, যাতে কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী নাকে-মুখে ঢুকে মারা না যায়।



ভারতের বাইরে জৈন ধর্ম পা রাখতে না পারলেও ভারতের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে জৈন ধর্ম প্রসার লাভ করেছিল। এর পিছনেও কার্য-কারণ সম্পর্ক ছিল। জৈন ধর্ম অহিংসার উপর এত বেশি জোর দিয়েছিল যে, কৃষিজীবীদের পক্ষে এই ধর্ম গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। কারন চাষের সময় গাছে পোকা লাগলে তা না মেরে হাতগুটিয়ে বসে থাকলে নিজেদের মরতে হয়। গাছে পোকা লাগা ও পোকাদের মেরে ফসল বাঁচানো কৃষিরই অঙ্গ।



ব্যক্তিগত সম্পত্তি-জমিজমা কেনা জৈনধর্মে নিষিদ্ধ। জমজমা কিনে শ্রমজীবীদের দিয়ে চাষবাস করে আয়ের পথও ছিল বন্ধ। ফলে জৈন ধর্মে দীক্ষিতরা ব্যবসার দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিল। গুজরাট মহারাষ্ট্রের উপকূলে নৌ-বাণিজ্যের সুবিধা ছিল। জৈন ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ পণ্যদ্রব্য নিইয়ে জাহাজ ভাসিয়ে দিলেন। ব্যবসা যে ভালই চলছিল , সে খবর জানতে পারি বিভিন্ন শিলালিপি থেকে। এইসব শিলালিপিতে ব্যবসায়ীদের নানা দান-ধ্যানের খবর থাকতো।



সংঘগুলো ব্যাঙ্কের মত কাজও করতো। বণিকরা সংঘের মারফত সুদে টাকা ধার দিত। মহারাষ্ট্রের নাসিকে পাওয়া একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, সুদের টাকায় একটি সংঘের কাজ পরিচালিত হত। বিজ্ঞানের উন্নতির পাশাপাশি ব্যাবসার উন্নতির ক্ষেত্রেও জৈনদের অবদান স্বীকার করতেই হয়। জৈন ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে আমরা জানতে পারি যে, আদিতে জৈনরা বাস করতেন প্রধানত কোসল, বেদেহ, মগধ ও অঙ্গ অঞ্চলে। তারপর আমরা জানতে পাচ্ছি কলিঙ্গ দেশে জৈনদের ছড়িয়ে পড়ার কথা। সেখানকার রাজা খারবেল জৈনধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর আমলে খণ্ডগিরি ও কুমারী পর্বতে কয়েকটি জৈন গুহা তৈরি হয়েছিল। পাবা'ইয় গড়ে উঠেছিল একটি মঠ।



জৈন ধর্ম তারপর ছড়িয়ে পরে মথুরায়। এই সময়টা হল প্রথম ও দ্বিতীয় শতক। এরপর জৈনদের প্রভাব ছড়ায় মালব ও উজ্জয়িনীতে। গুপ্তযুগের বিভিন্ন পুরাতত্ব নিদর্শন থেকে জানা যায় যে সে সময় জৈন ধর্মের প্রভাব ছিল। পাহাড়পুর, তক্ষশীলা ও গুজরাটেও জৈন ধর্ম প্রভাব বিস্তার করে।



সপ্তম থেকে দশম শতকে জৈন ধর্মে দেখা দেয় ভাটার টান। শেষ পর্যন্ত জৈন ধর্ম টিকে রইল কিছু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে, যাদের সঙ্ঘভাগই গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশবাসী।

শুক্রবার, ৩ জুন, ২০১১

বৌদ্ধ মতবাদ

বৌদ্ধ মতবাদ বলতে যে সব বাজারে চলতি বই রয়েছে তাতে বৌদ্ধত্বের চেয়ে হিন্দুত্বের প্রভাব প্রবল। যে বুদ্ধ নিরীশ্বরবাদী, কার্যকারণ সম্পর্কে বিশ্বাসী- সেই বুদ্ধকে দেবতা বানিয়ে ছাড়তে কেউই প্রায় কসুর করেননি। বুদ্ধকে ঘিরে কাহিনী ও তথাকথিত ইতিহাসে অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি। পালি ভাষায় বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে প্রথম লেখা হয় তাও বুদ্ধের মৃত্যুর কয়েক'শ বছর পরে। তখন আদি বৌদ্ধ ধর্মের রূপান্তর ও বিভাজন হয়েছে। পালি বৌদ্ধশাস্ত্রে আমরা পেলাম পল্লবিত, অলৌকিকে ভরা বুদ্ধকে।


সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মও আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ নাগাদ। পিতা শুদ্ধোধন ছিলেন শাক্য উপজাতি গোষ্ঠীর প্রজাতন্ত্রের পার্লামেন্ট বা গণসংস্থার সদস্য। এই সময় ভারতবর্ষে আরো কিছু গণরাজ্য বা প্রজাতন্ত্র ছিল। এইসব গণরাজ্যের, গণসংস্থার সদস্যকে রাজা বলা হত। বুদ্ধ সাহিত্য বিনয়পিটক, বুদ্ধচর্যা, মজ্ঝিমণিকা ইত্যাদি থেকে আমরা জানতে পারছি শাক্য প্রজাতন্ত্রে শুদ্ধধন ছা'ড়াও রাজা ছিলেন ভিদ্দিয় এবং দণ্ডপাণি।


গৌতমের মা মায়াদেবী পিত্রালয়ে যাবার পথে কপিলাবস্তুর কাছে লুম্বিনীতে গৌতমের জন্মও দেন। লুম্বিনীর বর্তমান নাম রুম্মিন্দেই, নেপাল-তরাই অঞ্চলের নৌতনবা স্টেশন থেকে আট মেইল পশ্চিমে। গৌতমের জন্মের সাত দিনের মধ্যে মায়াদেবীর মৃত্যু হয়। মাসি তথা বিমাতা গৌতমী শিশুটিকে পালনের দায়িত্ব নেন। গৌতমী-পালিত পুত্রের নাম হয় গৌতম। যৌবনে গৌতমের বিয়ে হয়। প্রতিবেশী কোলিয় গণরাজের কন্যা যষোধরা। পুত্র রাহুলের জন্ম হয়। গৌতম ঐশ্বর্যের মধ্যেই বড় হয়েছিলেন। সাধারণের দুঃখ-দারিদ্রের কষ্ট তার অজানা ছিল। বার্ধক্য, রোগ ও মৃত্যু দেখে তিনি মানসিকভাবে আঘাত পান। এই দুঃখময় জীবন থেকে পরিত্রাণের উপায় খূঁজতে সংসার ছেড়ে পথে বেড়িয়ে পরেন।


পরিব্রাজক গৌতম প্রথমে যান আলার কালাম এর কাছে। সেখানে কিছু যোগাভ্যাস শেখেন। তাতে মন পরিতৃপ্ত হল না। এরপর যান রামপুত্তের কাছে। সেখানেও কিছু যোগবিদ্যা শেখেন। এরপর তিনি বোধগয়ার কাছে ছয় পবছর যোগ-সাধনা। দীর্ঘ সময় ধরে অনশনে থেকে যোগ-সাধনা করেন। তাতে পরিতৃপ্তি এল না। বোধ বা জ্ঞান এল না। এল অনশনের কারণে কৃশতা ও দুর্বলতা। এই সময় সুজাতা নামের এক গোপকন্যার সঙ্গে গৌতমের পরিচয় হয়। সুজাতা বলেন, এমন দুর্বল শরীরে চিত্তের একাগ্রতা আনা বা সমাধি আনা অসম্ভব। শরীরকে সুস্থ রাখতে খাদ্যগ্রহণ প্রয়োজন। সুজাতা ছিলেন উন্নতমনা। তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা গৌতমের পূর্ব-ধারণা পরিবর্তিত হয়। গৌতম 'বুদ্ধ' হবার পর নারীদেরকেও দীক্ষা দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। ধনী মহিলা বিশাখা যেমন বুদ্ধের গৃহীশিষ্যা ছিলেন, তেমন বিমাতা গৌতমীও সঙ্ঘের সদস্যা হন।


যাই হোক, সুজাতার যুক্তি মেনে গৌতম খাবার গ্রহণ করলেন। এতে গৌতমের পাঁচ সাধনসঙ্গী গৌতম আদর্শচ্যুত হয়েছেন মনে করে তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেন।


একটু সবল হয়ে গৌতম নিরঞ্জনা নদীর তীরে এক বটগাছের তলায় বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। জীবন ও জগৎ রহস্য নিয়ে তিনি নতুন বোধ বা উপলব্ধিতে পৌঁছলেন। নিজের দুঃখময় জীবন থেকে নির্বান লাভ করে বুদ্ধ হলেন। আত্মনিগ্রহ থেকে বিচ্যুত দেখে যে পাঁচ সঙ্গী বুদ্ধের সং ত্যাগ করেছিল, তাঁদের সন্ধানে তিনি সারনাথে গেলেন। সেখানে সঙ্গীদের পেলেন। তাঁদের সামনে নিজের নতুন পাওয়া 'বোধ' বিষয়ে বক্তব্য রাখলেন। এই বক্তব্য বা ভাষণ বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছে 'ধর্মচক্র-প্রবর্তন' হিসেবে খ্যাত। অই পাঁচ শিষ্যকে নিয়ে বৌদ্ধ দঙ্ঘের সূচনা। ধর্মচক্র প্রবর্তনের চার মাসের মধ্যে বুদ্ধের সীক্ষিত সন্ন্যাসীর সংখ্যা দাঁড়ায় ষাটে। এরপর বুদ্ধ আরো চুয়াল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের নানা অঞ্চলে ঘুরেছেন। অধিবাসীদের উপদেশ দিয়েছেন। এইসব উপদেশে ভক্তির চেয়ে যুক্তি-বুদ্ধির দিকে জোর দিয়েছিলেন বেশি।


আশি বছর বয়সে কুশীনারা বা কুশীনগরে (বর্তমান কসয়া, গোরখপুর জেলা) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বুদ্ধের জীবনী জানতে পড়তে পারেন- বুদ্ধচরিত, ললিতবিস্তর, মহাবস্তু, বিনয়কথা,নিদানকথা,বিনয়পিটক,মজ্ঝিমণিকা,মহাপাদন-সুত্ত,মহানির্বান-সুত্ত,সুত্তনিপাত ইত্যাদি। আরো পড়তে পারেন নরেন্দ্রনাথ ভাট্টাচার্যের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস, রাহুল সাংকৃত্যাওনের বৌদ্ধ দর্শন।


বুদ্ধের চার সিদ্ধান্ত :

বুদ্ধের উপদেশাবলী বুঝতে হলে বুদ্ধের মূল চার সিদ্ধান্ত জানাটা খুবই জরুরু। সিদ্ধান্তগুলো হল :

১. ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করা।

২. আত্মাকে 'নিত্য' স্বীকার না করা।

৩. কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসেবে স্বীকার না করা।

৪. জীবন প্রবাহকে স্বীকার করা।


. ঈশ্বরের অস্তিত্বে সীকার না করা :

জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বুদ্ধ অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর মতে- 'জগতের সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক নিয়মে। জগৎ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রকৃতি জগতের স্বাভাবিক নিয়ম দ্বারা।' কেউ কেউ মনে করেন, ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা, যেমন কুম্ভকার মৃতপাত্রের স্রষ্টা। ঈশ্বর সর্বব্যাপী। ঈশ্বর স্রষ্টা হলে তিনি কুম্ভকারের মত মাটি ও মৃতপাত্র হতে পৃথক। ঈশ্বর যদি তাঁর সৃষ্টি থেকে পৃথক হন, তবে তিনি সর্বব্যাপ্ত হতে পারেন না।


ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, তাঁর ইচ্ছাতেই যদি মানুষের কাজ-কর্ম নির্ধারিত হয়, তবে অসট কাজের জন্য মানুষ কেন দায়ী হবে?


মনুষ্য জগতের বাইরের অন্যান্য প্রাণী, যাদের ভাল-মন্দ বিচার-বোধ নেই, তাদের কাজ-কর্মের জন্য ঈশ্বর কীভাবে তাদের দায়ী করবে?


পৃথিবীতে সুখের চেয়ে দুঃখের পরিমাণ বেশি। তবে কি ঈশ্বর যতটা দয়ালু, তারচেয়ে বেশি নিষ্ঠুর?


সমস্ত ঘটনার পিছনে কার্য-কারণ থাকে। বুদ্ধের এই সর্বব্যাপী কার্য-কারণ তত্ব 'প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ' নামে পরিচিত। কার্য-কারণ সম্পর্ক ছাড়া মানসিক জগতের বা বাইরের জগতের কোন কিছু ঘটা সম্ভব নয়। আমাদের জীবনে যে দুঃখের 'প্রতীত্য' বা প্রাপ্তি ঘটে তার পেছনেও আছে 'সমুৎপাদ' বা উৎপত্তির কারণ। কারণ দুটি। ১. তৃষ্ণা ও ২. অবিদ্যা। ইন্দ্রিয়সুখের প্রতিটি তৃষ্ণাই মানুষ্কে লোভী, নিষ্ঠুর ও হত্যাকারী করে তোলে। দুঃখ যেমন আছে, দুঃখ নিবারণের উপায়ও তেমনি আছে। দুঃখ বিনাশের পথ হিসেবে বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গের উপদেশ দিয়েছেন।


মানুষের জীবনে দুঃখ অনিবার্য, বুদ্ধের এই মতবাদ দুঃখবাদ নামে পরিচিত। অবিদ্যাকে দুঃখবাদের একটি কারণ বলে বুদ্ধ উল্লেখ করেছেন, এ'কথা আমরা আগেই জেনেছি। অবিদ্যা বলতে তিনি বলেছেন সঠিক জ্ঞানের অভাব বা সম্যক জ্ঞানের অভাব, সত্য সম্বন্ধে অজ্ঞানতা, স্রেষ্ঠ-সত্য না জানা। আমাদের জানতে হবে, চার মহাভূত পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি থেকেই জগতের সবের সৃষ্টি, ধ্বংসে সবই এই চারে বিলীন হয়। ইন্দ্রিয় সম্পর্কিত বিজ্ঞানকে জানতে হবে। ছয় ইন্দ্রিয় হল- চক্ষু, শ্রবণ, ঘ্রাণ, জিহ্বা, ত্বক ও মন। বিজ্ঞান হল চেতনা বা মনেরই নাম। বুদ্ধের কথায়, 'আমাদের যাবতীয় দুঃখের কারণ তৃষ্ণা ও অবিদ্যা। দুঃখ ঈশ্বরের রুষ্টতা থেকে আসে না। ঈশ্বর মানুষের মনোজগতের কল্পনা।'



২. আত্মাকে নিত্য স্বীকার না করা :

বৌদ্ধযুগে বেদ-বিশ্বাসী ব্রাহ্মণ ও পরিব্রাজকেরা মনে করতেন, আত্মা এক নিত্য ও চেতন শক্তি। অর্থাৎ আত্মা অমর, যার ক্ষয় নেই, যার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, যাকে অস্ত্র দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না। এই নিত্য চেতন শক্তি শরীর থেকে পৃথক। কোন দেহে চেতনা বা আত্মা থাকলে সে তখন জীবিত। দেহ থেকে চলে গেলে মৃত। এই সময় কিছু উন্নত চিন্তার এগিয়ে থাকা মানুষ জানালেন- আত্মা শরীরেরই গুণ, শরীর থেকে পৃথক কোন শক্তি নয়। শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণে ভূত-পদার্থের (মৌল পদার্থের) মিশ্রণের রাসায়নিক বক্রিয়ার ফলে শরীরে উষ্ণতা, উদ্যম ও চেতনা সৃষ্টি হয়। ভূত পদার্থের তারতম্য ঘটলে আবার তা হারিয়ে যায়। বুদ্ধ আত্মাকে 'অনিত্য' বললেন। তবে তাঁর এই 'অনিত্য' শব্দার্থ তাঁর সমসাময়িক চিন্তাবিদদের 'অনিত্য' শব্দার্থের চেয়ে কিছু আলাদা।


বুদ্ধ আত্মার সংজ্ঞা দিলেন- 'চিত্ত-বিজ্ঞান' বা 'মনো-বিজ্ঞান' আর 'আত্মা' একই বস্তু। আমরা যেভাবে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বা এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে প্রত্যক্ষ করতে পারি, মনকে সে'ভাবে পারি না। চোখ হয়তো লোভনীয় খাদ্যবস্তু দেখতে পেল। নাক তার গন্ধ এনে দিল। জিহ্বা ইন্দ্রিয় ভোগ তৃষ্ণা অনুভব করল। জিভে জল চলে এল। এই যে চোখ, নাক ও জিভ এই তিন ইন্দ্রিয়কে মেলাবার ভূমিকা যে পালন করল সেও ইন্দ্রিয়। বিভিন্ন ইন্দ্রিয়কে চালনাকারী ইন্দ্রিয়ের নাম 'মন'। এই মন বা চিত্তই আত্মা, ( মনোবিজ্ঞান অবশ্য ;মন'কে ইন্দ্রিয় বলে স্বীকার করে না।)


বুদ্ধের মতে- 'সবকিছুই অনিত্য, ক্ষণস্থায়ী। ' বুদ্ধের এই সর্বব্যাপী পরিবর্তন, বিবর্তন, অনিত্য তত্বই 'ক্ষণিকবাদ' নামে পরিচিত। ক্ষণিকবাদ অনুসারে জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল। যার শুরু আছে, তার শেষ আছে। যার জন্ম আছে, তার মৃত্যু আছে। জাগতিক বস্তু, প্রাকৃতিক বস্তু ও মানসিক চিন্তা-ভাবনা সবই নিরন্তন পরিবর্তিত হচ্ছে। বুদ্ধের কথায় এই পরিবর্তনই একমাত্র সৎ, শাশ্বত, সনাতন।


যে প্রদীপ শিখাকে আমরা জ্বলন্ত দেখি, সেই শিখার কিছুক্ষণ আগে দেখা আগুন ও কিছুক্ষণ পরে দেখা আগুন এক নয়। প্রতিটি মুহূর্তে জ্বলছে নতুন আগুন। যতক্ষণ প্রদীপে তেল ও পলতে থাকবে ততক্ষণ আগুন জ্বলবে। প্রতিটি মুহূর্তের ভিন্ন ভিন্ন আগুনের শিখাকে প্রতিটি মুহূর্তে আমরা দেখছি এবং ভাবছি- একই আগুন।


আমাদের শরীর প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আসা একটি মানুষের কথা ভাবুন। পাঁচ মাসের শিশু, পনেরোর কিশোর, পঁচিশের যুবক ও পঞ্চাশের প্রৌঢ়ের শরীর এক নয়। আমাদের শরিরের প্রতিটি অণু (বর্তমানে আমরা বলি দেহকোষ) প্রতিক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে। পাঁচ মাসের শরীর ও পঞ্চাশ বছরের শরীর এক থাকেনা। একই ভাবে একই মানুষের পাঁচ মাসের মন, পনেরোর কিশোর মন, পঁচিশের যুবক মন ও পঞ্চাশের প্রৌঢ় মন এক থাকে না। এই মন্রূপ আত্মা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।


মনের বাইরে কোন আত্মা নেই। মন বা চিত্ত-বিজ্ঞান প্রতিটি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। কোন কিছু আমাদের আনন্দ দেয়, আবার কোন ঘটনা আমাদের দুঃখ। কখনো আমরা ক্রুদ্ধ হই, আবার কখণো বা ভীত। ফলে আমাদের মন বা আত্মাও পরিবর্তিত হচ্ছে।

প্রশ্ন আস্তেই পারে- মন বা আত্মা যদি ক্ষণিক হয়, তবে আমাদের অভিজ্ঞতা স্মৃতিরূপে মনে থাকে কী করে? উত্তরে বুদ্ধের মত- বংশের ধারা অনুসারে মা-বাবার কিছু রূপ-গুণ-দোষ সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্মে দেখা যায়। তেমনই আমার পনের বছরের মন তার অভিজ্ঞতাকে উত্তরাধিকার সূত্রে পঞ্চাশ বছরের মনকে দেয়; আর তারই ফল স্মৃতি।


বুদ্ধ জানালেন, 'আত্মা বা চিত্ত-বিজ্ঞান যেহেতু শরীরেরই গুণ, তাই শরীর বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে আত্মারও বিনাশ ঘটে।'


৩. কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ বলে স্বীকার না করা:

বহু উপাসনা-ধর্মই নিজেদের ধর্মগ্রন্থকে 'স্বতঃপ্রমাণ' বলে বিশ্বাস করে। 'স্বতপ্রমাণ' কথার মানে- প্রশ্নাতীতভাবে চিরন্তন সত্য বলে ভেবে নেয়া, গ্রন্থে লিখিত প্রতিটি কথাকে প্রমাণ বলে মেনে নেয়া। কেন এই মেনে নেয়া? কারণ এইসব ধর্মগ্রন্থগুলো কোন মানুষের রচিত নয়। ঈশ্বরের দৈববাণী বা ঈশ্বর কথিত।

বুদ্ধের অন্যতম মূল সিদ্ধান্ত হল- 'কোন ধর্মগ্রন্থই স্বতঃপ্রমাণ হতে পারে না। সমস্ত দেশে, সমস্ত কালের জন্য ধর্মগ্রন্থের কথা সৎ বা শাশ্বত হতে পারে না। ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি কথাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়ার অর্থ কার্য-কারণ সম্পর্ক খোঁজা থেকে বিরত থাকা।'


অর্থাৎ প্রতীত্যসমুৎপাদবাদকে অস্বীকার করা। অবিদ্যাকে প্রশ্রয় দেয়া। সম্যক দৃষ্টি বা সঠিক জ্ঞান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। বস্তুত কোন গ্রন্তের প্রামাণিকতা নির্ধারিত হয় মানুষেরই জ্ঞান-বুদ্ধি, যুক্তি-বুদ্ধির দ্বারা। জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তি-বুদ্ধির প্রয়োগ ছাড়া কোন কিছুকে 'প্রমাণিত সত্য', 'প্রমাণিত শাশ্বত' বলে মেনে নেয়া বিজ্ঞান বিরোধী।


ঈশ্বর যখন অস্তিত্বহীন, তখন ঈশ্বরের দৈববাণী নিয়ে বা ঈশ্বরের কথা নিয়ে ধর্মগ্রন্থ গড়ে উঠেছে, এমন তত্বকে স্বীকার করা যায় না।

আড়াই হাজার বছর আগে ধর্মগ্রন্থগুলোর স্বতঃপ্রমাণ অস্বীকার করেছিলেন বুদ্ধ। কী বিশাল যুক্তিমনস্কতার পরিচয় তিনি সেই সময়ে দিয়েছিলেন, ভাবলে আজও বিস্মিত হতে হয়।


কোন ধর্মগ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ বলে মেনে নেয়ার অর্থ, ওই গ্রন্থে লেখা কোন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কেড়ে নেয়া। জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে অগ্রগতির যে বিবর্তন আসে, তাকে ব্রোধ করা। যদি গ্যালিলিও বাইবেলের কথাকে স্বতঃপ্রমাণ বলে মেনে নিতেন, তবে তাঁর কাছে পৃথিবী গোল না হয়ে চ্যাপ্টাই থাকতো। গ্যালিলিও প্রমাণ করেছেন, বাইবেল স্বতঃপ্রমাণ কোন গ্রন্থ নয়। কোপারনিকাস প্রমাণ করেছেন, বাইবেলের কথা মেনে সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না।


বাইবেল-বেদ-গিতা-কোরান বা অন্য যে কোন তথাকথিত স্বতঃপ্রমাণ গ্রন্থই বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যে বলে প্রমাণিত হয়ে চলেছে। আড়াই হাজার বছর আগে একজন বুঝেছিলেন, কোন ধর্মগ্রন্থই স্বতঃপ্রমাণ নয়, ঈশ্বর সৃষ্ট নয়। আড়াই হাজার বছর পরে আমরা একটুও না এগিয়ে আরো পিছিয়ে পড়েছি। 'আমরা' মানে সিংহভাগ তথাকথিত শিক্ষিতরা।


৪. জীবনপ্রবাহকে স্বীকার করা :

বুদ্ধের 'জীবনপ্রবাহ তত্ব' ও হিন্দু উপাসনা-ধর্মের 'জন্মান্তরবাদ' এক বিষয় নয়। বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধ ধর্মে নানা বিভাজন এসেছে। হিন্দু ভাববাদী বা বৈদিক ভাববাদী প্রেরণা থেকে 'মহাযান'-এর উদ্ভব। মহাযানপন্থীরা বৌদ্ধধর্মের মূল চার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এল। তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করল। বুদ্ধকে প্রথমে দেবতা, পরে সর্বোচ্চ দেবতার পরে বসাল। বুদ্ধের অবস্থান হল স্বর্গে। তিনি হলেন। তিনি হলেন বিভিন্ন দেব-দেবীর উপর প্রভুত্বকারী দেবতা। এল দেব-দেবীর পূজার বিধান। মুক্তির উপায় হিসেবে অষ্টাঙ্গিক মার্গ (বুদ্ধের আটটি উপদেশ) অনুশরণের প্রয়োজন ফুরালো। মুক্তির উপায় হিসেবে মন্ত্রের ব্যবহার অনুমোদিত হল। তারপর অনুপ্রবেশ ঘটল হিন্দু উপাসনা-ধর্মের, তন্ত্রের। আত্মার অমরত্ব স্বীকৃতি পেল। এল জন্মান্তরবাদ। গড়ে উঠল বুদ্ধএর জাতক কাহিনী, যা বুদ্ধের নানা জন্মান্তরের কাহিনী। বুদ্ধের জীবনপ্রবাহবাদকে হিন্দু উপাসনা-ধর্মের জন্মান্তরবাদের সঙ্গে গুলিয়ে দেয়া হল। অথচ বুদ্ধ কখনই আত্মাকে 'নিত্য' বলে স্বীকার অরেন নি। অনিত্য আত্মার জন্মও নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।


বুদ্ধের কথায়- জন্মান্তর বলতে চিরন্তন আত্মার নতুন দেহ ধারণ বোঝায় না। জন্মান্তর অর্থে একটি জীবন থেকে আরো একটি জীবনের উদ্ভবকে ভোঝায়, অর্থাৎ জীবনপ্রবাহকে বোঝায়। আমাদের মধ্যে যে চিত্ত-বিজ্ঞান প্রক্রিয়ার প্রবাহ রয়েছে, সেই চিত্ত-বিজ্ঞান প্রক্রিয়াই একটি মানুষের জীবন থেকে আরো একটি নতুন মানুষের জন্মে প্রবাহিত হয়।


জীবনপ্রবাহকে আরো স্পষ্ট করতে বুদ্ধ প্রদীপ শিখার উদাহরণ দিয়েছিলেন। একটি প্রদীপ থেকে যখন আরো একটি প্রদিপ জ্বালানো হয়, তখন প্রথম শিখা থেকে দ্বিতীয় শিখার জন্মও হয়। যদিও দুটি শিখা পৃথক ও স্বতন্ত্র, তবু একটা শিখা থেকে আরো একটা শিখার জন্মের মধ্যে প্রথম শিখার গুণ দ্বিতীয় শিখায় প্রবাহিত হল। তেমনি একটি জীবন থেকেই আরো একটি জীবনের সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে প্রথম জীবনের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বা গুণও প্রবাহিত হয় তার সৃষ্ট জীবনে। এই সৃষ্টি ও কিছু বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিক জীবনপ্রবাহ, জীব থেকে জীবের জন্মপ্রবাহ যতদিন থাকবে ততদিন চলবে।


বৌদ্ধ দর্শনের মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন (জন্মও ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩, মৃত্যু ১৪ এপ্রিল ১৯৬৩) দীর্ঘকাল বৌদ্ধদর্শন দিয়ে গবেষণা ও চর্চা করেছেন। বৌদ্ধধর্মে বস্তুবাদের রূপরেখা দেখতে পেয়েছিলেন। বুদ্ধকে জানতে, তাঁর দর্শনকে জানতে রাহুল তিব্বতি লামার ছদ্মবেশে তিব্বতে হাজির হন- একবার নয়, চারবার। সেখান থেকে গোপনে সংগ্রহ করে আনলেন অতি মূল্যবান বহু পউঁথি, পাণ্ডুলিপি, চিত্রপট ও পুস্তক। দেশ থেকে তিব্বতে চলে যাওয়া এইসব সম্পদ উদ্ধার করে এনেই থেমে থাকলেন না রাহুল। সে সব তিব্বতি ভাষা থেকে সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে রাহুলের পাণ্ডিত্য নিয়ে গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত ভারতীয় পণ্ডিতেরা। তাই আমাদেরও রাহুলের মতকে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ।


দার্শনিক জগদীশ্বর সান্যাল তাঁর 'ভারতীয় দর্শন' গ্রন্থে লিখেছেন, 'বুদ্ধদেব বলেন, জন্মান্তর বলতে চিরন্তন আত্মার নতুন দেহ ধারণ করা বোঝায় না। জন্মন্তর অর্থে একটি জীবন থেকে আর একতি জীবনের উদ্ভবকে বোঝায়।'


এরপর বলতেই হয়, বুদ্ধ কখনই হিন্দুত্ববাদীদের মত কিংবা জাতক কাহিনী-মার্কা জন্মান্তরে বিশ্বাস করতেন না।


দুঃখ এই, আমাদের দেশের মানুষ বুদ্ধকে সম্মান জানায় তাঁর মূল আদর্শের জন্য নয়, তাঁর আদর্শকে নিজেদের মনের মত বিকৃত করে নেয়ার পর।


অষ্টাঙ্গিক মার্গ :

দুঃখ বিনাশের পথ হিসেবে বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথা বলেছেন। অষ্টাঙ্গিক মার্গকে তিনটি স্কন্ধে বা বিভাগে ভাগ করা হয়েছে।

১. প্রাজ্ঞা বা জ্ঞান, ২. শীল বা সদাচার ও ৩. সমাধি বা চিত্তের একাগ্রতা।


১. প্রজ্ঞা :

ক. সম্মা দিট্‌ঠি বা সম্যক দৃষ্টি (বুদ্ধ সঠিক জ্ঞান, যথার্থ দর্শনকে সম্যক দৃষ্টি বলেছেন)

খ. সম্মা সংকল্প বা যথার্থ সংকল্প (বুদ্ধ ক্রোধ-হিংসা-প্রতিহিংসা ত্যাগ করাকেই যথার্থ সংকল্প বলেছেন)


২. শীল :

গ. সম্মা বাচা বা যথার্থ বাক্য (বুদ্ধ যথার্থ বাক্য বলতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, সত্য এবং প্রিয় ভাষণ দেবে। মিথ্যা ভাষণ, কটু বাক্য, হেতুহীন বা অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে বিরত থাকবে।

ঘ. সম্মা কম্মন্ত বা সৎ কর্ম (হিংসা, চুরি, ব্যাভিচার না করা)

ঙ. সম্মা আজীবা বা সৎ জীবিকা (বুদ্ধ বলেছেন, সৎ জীবিকা দ্বারা জীবন ধারণ ও পরিবার পালন করবে। অসৎ জীবিকা পরিত্যাগ করবে। অসৎ জীবিকা বলতে বুদ্ধ অস্ত্রব্যাবসা, প্রাণী-ব্যাবসা, মাংস ব্যাবসা, মদ্য ব্যাবসার উল্লেখ করেছেন। সুদ ব্যাবসা ও দেহব্যাবসা সেই সময়কার সমাজে প্রচলিত ছিল। এই দুই বিষয়ে বুদ্ধ বিড়ূপ কিছু বলেন নি।)


৩. সমাধি :

চ. সম্মা বায়াম বা যথার্থ ব্যায়াম (যথার্থ ব্যায়াম বলতে বুদ্ধ দৈহিক বা মনষিক ব্যায়ামের কথা বলেছেন। শারীরিক স্রম, সু-চিন্তা ভাবনা করা, ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখার উপদেশ দিয়েছেন। কুচিন্তাকে দূরে রাখতে বলেছেন।

ছ. সম্মা মতি বা সম্যক মনন (সম্যক মনন বলতে বুদ্ধ মালিন্যহীন মনের কথা বলেছেন। চিত্ত যে ক্ষণস্থায়ী, এই বিজ্ঞানকে মনে রেখে অমলিন ও সুন্দর মনের প্রবাহ বজায় রাখতে উপদেশ দিয়েছেন।

জ. সম্মা সমাধি বা যথার্থ ধ্যান (বুদ্ধ বলেছেন, চিত্তের একাগ্রতার নামই সমাধি।)


বৌদ্ধ সংঘ :

মূলত সংসারত্যাগী মুক্তিকামী মানুষদের নিয়ে বুদ্ধ সঙ্ঘ গড়ে তোলেন। সঙ্ঘেরনিয়ম-কানুনে বুদ্ধ উপজাতি বা ট্রাইবাল সমাজের প্রচলিত প্রথাগুলোকে অনুসরণ করেছিলেন।


উপজাতি সমাজের অন্তর্ভূক্ত হবার দুইটি প্রথা আছে। ১. বয়ঃসন্ধিকালে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একজনকে সমাজের পূর্ণ সদস্য করা হয়। ২. বহিরাগত কেউ সমাজের সদস্য হতে গেলে সমাজের সকলের সদস্যের প্রয়োজন হয়। কেউ আপত্তি তুললে সদস্য করা হয় না। বৌদ্ধ সঙ্ঘে একই নিয়মের প্রচলন করেছিলেন বুদ্ধ। সঙ্ঘে যোগ দিতে চাইলে নাম, ঠিকানা, বয়স, পিতা-মাতার সম্মতির প্রমাণ ও অতীত ইতিহাস ঘোষণা করতে হত। সংঘের সকলের সম্মতি মিললে তাকে দীক্ষান্তে গ্রহণ করা হত। দীক্ষা গ্রহণকয়ারীর বয়স হতে হত অন্তত পনেরো বছর। কোন বিবাহিতা রমণী সঙ্ঘের সদস্য হতে চাইলে তার স্বামীর অনুমতির প্রয়োজন হত।


আদিম কিছু উপজাতি সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছুই নেই। তেমনই সঙ্ঘ সদস্যের কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। দিনে একবার খাবার খেতেন। বিশেষ কোন খাবারের প্রতি আগ্রহ নিশিদ্ধ ছিল। পোশাক বলতে হলুদ রঙ্গে ছোপানো তিন টুকরা কাপড়। সঙ্গে ওষুধ রাখতে পারতেন ভিক্ষুরা। যে গ্রামেই ভিক্ষুরা থাকুন না কেন, অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় তাঁকে নিজের সংঘের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হতে হত।

সঙ্ঘ পরিচালিত হত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। সঙ্ঘ-প্রধান নির্বাচিত হতেন। উত্তরাধিকারী নিয়োগ নিষিদ্ধ ছিল। কোন গুরুত্বপূর্ণ নিষয় নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হলে তা সকলের উপস্থিতিতেই হত। সমবেত জীবনচর্চা ও গণতন্ত্র ছিল সঙ্ঘের বৈশিষ্ট।


ত্রিপিটক :

বুদ্ধ নিজে কোন গ্রন্থ রচনা করেননি। তাঁর মৃত্যুর পরে কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তিনটি 'পিটক' বা পেটি রচনা করেছিলেন। তিনটির একত্রিত নাম ত্রিপিটক। পিটক তিনটি হল :

১. বিনয়পিটক : এতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আচরণ সঙ্ক্রান্তকিছু নির্দেশ আছে।

২. সূত্তপিটক : এতে আছে বুদ্ধের জাতক কাহ্নী। এর আবার পাঁচটি ভাগ- ক. দীর্ঘনিকায়, খ. মঝ্‌ঝিম নিকায়, গ. সংযুক্ত নিকায়, ঘ. অঙ্গুত্তর নিকায় ও ঙ. খুদ্‌দক নিকায়।

৩. অভিধম্মপিটক : এতে আছে দার্শনিক আলোচনা।


বৌদ্ধধর্মে বিভাজন :

বুদ্ধের মৃত্যুর পর সঙ্ঘগুলোর মধ্যে বিভেদ শুরু হতে থাকে। প্রাচীনপন্থী বৌদ্ধদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী বৌদ্ধদের একটু একটু করে বাড়তে থাকে। বৌদ্ধ সাহিত্যগুলোতেও তার প্রতিফলন বাড়তে থাকে।


প্রাচীনপন্থীরা বা হীনযানপন্থীরা দাবি করেন, তারা বৌদ্ধ ধর্মের প্রকৃত চিন্তাধারাকে অবিকৃতভাবে ধরে রেখেছেন। সে দাবিকে অবশ্য উড়িয়ে দেয়া যায় না। তারা মনে করেন- বুদ্ধ একজন মানুষ ছিলেন। তিনি বহুগুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। তাঁর মানবিক দুর্বলতাও ছিল, যেমন অসহিষ্ণুতা, রোগকাতরতা (চাতুমা-সুত্ত, সেখ-সুত্ত) ইত্যাদি।


একসময় প্রাচীনপন্থীরা সাতটি উপদলে ভাগ হয়ে যায়। মহাযানপন্থীরাও তাদের বিভাজন ঠেকাতে পারেননি। তারা আঠারোটি সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে যায়।

হীনযানপন্থীরা রইলেন বুদ্ধের নীতি নিয়ে। মহাযানপন্থীরা আবদ্ধ রইলেন বুদ্ধকে ঈশ্বর বানিয়ে পুজো করার মধ্যে। সঙ্গে যুক্ত করলেন তন্ত্র-সাধনা। মহাযানপন্থীদের হাতে শুরু হল বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয়।


নির্বান :

'নির্বান' মানে 'নিভে যাওয়া'। যেমন প্রদীপের আগুন জ্বলতে ক্বলতে নিভে যাওয়া। বৌদ্ধ ধর্মে 'নির্বান' শব্দটির গুরুত্ব খুবই বেশি। বুদ্ধ 'নির্বান' বলতে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, এই নিয়ে পরবর্তীকালে বৌদ্ধদের মধ্যে যথেষ্ঠ মতভেদ দেখা দেয়। এর কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের উপর বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রভাব। 'নির্বান' বিষয়ে প্রধান তিনটি মত নিয়ে নিচে আলোচনা করা হল :


১. বুদ্ধের মতে, জীবনে দুঃখ আছে, দুঃখ নিবারণের বা নির্বাপনের পথও আছে। দুঃখের পরিসমাপ্তির নামই 'নির্বান'। বুদ্ধের মতে চার 'আর্যসত্য' বা মৌলিকসত্য হল ক. দুঃখ, খ. দুঃখের কারণ, গ. দুঃখের কারণ বিনাশের উপায় ও ঘ. বিনাশ।

এই চার আর্যসত্য হল বৌদ্ধ ধর্মের মূল কথা। এই মূল কথা মেনে নিলে আমরা বনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারি যে- দুঃখের বিনাশই নির্বান।


২. 'চিরবিলুপ্তি'। বৌদ্ধ দার্শনিক হিসেবে নাগসেন অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত একটি নাম। নাগসেনের জন্মও আনুমানিক ১৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। মগধে নন্দ যখন রাজত্ব করছেন, সেই সময় আলেকজান্ডার গান্ধার (বর্তমান পাঞ্জাব) অঞ্চল আক্রমণ করেন ও দখল করেন। ফলে গান্ধার অঞ্চলে লাখখানেক গ্রিক বসবাস শুরু করেন। এদের মধ্যে সেনা-ভাস্কর-শিল্পী-ব্যবসায়ী ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার মানুষ ছিলেন। ভারতবর্ষে বসবাসকারী গ্রীকদের সঙ্গে রাজধর্ম বৌদ্ধদের মত বিনিময়ের সুযোগ ছিল এবং মত বিনিময় হত। গ্রিক ভাস্কররাই বুদ্ধকে কল্পনা করে নিজেদের শৈলীতে সৃষ্টি করেছিলেন পাথর খোদাই বুদ্ধ মূর্তি। পাশাপাশি ভারতীয় দর্শনের উপর গ্রিক দার্শনিকদের প্রভাব পড়েছিল। 'যবন' বা 'ম্লেচ্ছ' বলে হিন্দুধর্মের মানুষেরা গ্রিকদের এড়িয়ে চলত। বৌদ্ধরাই ভারতীয় ভাবধারার সঙ্গে যবন গ্রিকদের ভাব্ধারা বিনিময়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল।


নাগসেনের জন্মও হয়েছিল শিয়ালকোটের কাছে। গ্রিক রাজা মিনান্দর বা মিলিন্দ এর রাজ্যের একটি রাজধানী ছিল শিয়ালকোট। মিনান্দর ছিলেন তার্কিক। ভালোবাসতেন শাস্ত্রচর্চা। মিনান্দর প্রকাশ্য সভায় বহু বৌদ্ধ শ্রমণদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলতেন। বৌদ্ধ সঙ্ঘের অনুরোধে নাগসেন শিয়ালকোটের অসংখেয় সঙ্ঘে হাজির হন ও মিনান্দরের সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মিনান্দর ৫০০ অমাত্য নিয়ে অসংখেয় মঠে হাজির হন। তাদের এই আলোচনা 'মিলিন্দ প্রশ্ন' (অনুবাদক : ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ) থেকে জানা যায়। 'মিলিন্দ প্রশ্ন'-তে নির্বান প্রসঙ্গ এসেছে। নাগসেন ও মিলিন্দ-র প্রশ্ন ও উত্তরের কিছু নমুনা-


মিলিন্দ - প্রভু, নিরোধ হওয়াকেই কি নির্বান বলে?

নাগসেন - হ্যাঁ মহারাজ। জ্ঞানী ব্যক্তি (যিনি অবিদ্যাকে দূর করেছেন) বিষয় তৃষ্ণায় ও ভোগে লিপ্ত হন না। ভোগের তৃষ্ণা তারা নিরোধ করতে পারেন। সকল দুঃখই রুদ্ধ হয়ে যায়। মহারাজ, এই ধরণের নিরুদ্ধ হওয়াকেই নির্বান বলে।

মিলিন্দ - বুদ্ধ কোথায় আছেন?

নাগসেন - মহারাজ, তিনি পরম নির্বান প্রাপ্ত হয়েছেন, যার পরে তাঁর ব্যক্তিত্বকে তৈরি রাখারমত আর কিছুই থাকতে পারে না...

মিলিন্দ - প্রভু, উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন।

নাগসেন - মহারাজ, নির্বাপিত অগ্নিশিখা কি আর দেখা যায়?

মিলিন্দ - না প্রভু। সে শিখা তো নির্বাপিত।


'নির্বান' অর্থে নাগসেন বিষয় তৃষ্ণা ও অবিদ্যার চির-বিনাশকে শুধু বোঝাননি, দেহেরও চির-বিলুপ্তির কথা বলেছেন।

নির্বানেই সব শেষ। গৌতম প্রায় ৩৫ বছর বয়সে নিজের দুঃখময় জগৎ থেকে নির্বান লাভ করে বুদ্ধ হয়েছিলেন। বুদ্ধ নির্বান লাভের পরেও দীর্ঘ বছর বেঁচে ছিলেন। এ থেকে আমরা ধরে নিতে পারি- বুদ্ধ 'নির্বান' অর্থে চিরবিলুপ্তি বোঝাননি।


৩. আনন্দময় অবস্থাই 'নির্বান' - এমনটাই মনে করেন মহাযানপন্থী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৌদ্ধরা। মহাযান বৌদ্ধধর্মে স্থানীয় অসংখ্য দেবদেবীর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ফলে বৌদ্ধধর্মে স্থানীয় অসংখ্য দেবদেবীর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। যে বুদ্ধ ছিলেন যুক্তিবাদী, নিরীশ্বরবাদী সেই বুদ্ধের ধর্মে যুক্ত হল বহু দেব-দেবীর পুজো, কার্য-কারণ সম্পর্কহীন (প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ বিরোধী) অলৌকিক বিশ্বাস। গৃহীত হল যৌন-আচারমূলক তন্ত্র-সাধন পদ্ধতি। বৌদ্ধতন্ত্রগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'গুহ্যসমাজ' বা তথাগত গুহ্যক ও 'মঞ্জুশ্রীমূলককল্প'। এতে মাংস, মুদ্রা (বিভিন্ন মৈথুন-ভঙ্গি) ও মৈথুনকে সাধনার অঙ্গ বলা হয়েছে। বুদ্ধের সঙ্গে নানা দেবীর মৈথুন বর্ণনা বৌদ্ধ তন্ত্রে আছে।


মহাযানপন্থীদের বৌদ্ধ তন্ত্র অনুসারে দীর্ঘস্থায়ী মৈথুনের মধ্যেই শুধু পাওয়া যায় অপার আনন্দ অনুভূতি, তখন সমস্ত মানসিক ক্রিয়া হারিয়ে ফেলে মানুষ। মিলনের এই অপার আনন্দই হচ্ছে 'নির্বান'।


বুদ্ধের মূল সিদ্ধান্ত ও উপদেশকে উড়িয়ে দিয়ে ধর্মের নামে 'নির্বান' প্রসঙ্গে নাগসেনের দেয়া সংঙ্গা ও মহাযানপন্থীদের দেয়া সংঙ্গা আমরা গ্রহণ করতে পারি না। বরং আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, মহাযানপন্থীদের পরিবর্তিত বৌদ্ধ ধর্ম স্পষ্টতই বুদ্ধ বিরোধী। তাদের 'নির্বান' সংঙ্গা হিন্দু তন্ত্রের দ্বারা পরিপূর্ণভাবে প্রভাবিত। আর নাগসেনের মতামত বুদ্ধের মত থেকে সামান্য সরে আসা। তাই আমরা 'নির্বান' শব্দটির সংঙ্গা হিসেবে প্রথমটিকেই গ্রহণ করব।

'নির্বান' অস্তিত্বের নাশ নয়। 'নির্বান' মৈথুনে ডুবে থাকার ভণ্ডামী নয়। গৌতম 'নির্বান' লাভ করে 'বুদ্ধ' হয়েছিলেন এই তথ্যই প্রমাণ করে 'নির্বান' মানে, দুঃখের বিনাশ।

বর্তমান বুদ্ধ বিরোধী মহাযানপন্থার ব্যাপক প্রচলন হয়েছে তিব্বত, চীন, জাপানে। ভারতে বৌদ্ধের সংখ্যা কম আর এদের মধ্যে মহাযানপন্থীদের সংখ্যাই বেশি। ফলে এ সব দেশে নিরীশ্বরবাদী বুদ্ধ ঈশ্বররূপে পূজিত হচ্ছেন। হীনযানপন্থার প্রসার ঘটেছে স্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ডে। এসব দেশে বৌদ্ধধর্ম কিছুটা হলেও মতাদর্শ রক্ষা করতে পেরেছে।

হীনযান ও মহাযানপন্থীরা বর্তমানে নানা ভাগে বিভক্ত। নতুন নতুন বিশ্বাস ও ভাবধারার অনুপ্রবেশের জন্যই এত বিভাজন।

বৌদ্ধ দর্শনের উপর নির্ভর করে, নানা বিভাজিত বুদ্ধের মতবাদের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা সাহিত্য-দর্শন-ইতিহাস-ধর্মগ্রন্থের সংখ্যা এতই বিপুল যে, কারও পক্ষেই এক জীবনে পড়ে ওঠা সম্ভব নয়।





ভারতবর্ষের তদকালীন সমাজব্যবস্থা এবং বুদ্ধ :

বুদ্ধের সময়কার সমাজে ব্যাপক ক্রীতদাস প্রথা ছিল, ভয়ংকর দারিদ্র্য ছিল। অত্যন্ত চড়া সুদে ঋণ দিতেন শ্রেষ্ঠী, বণিক, ধনী সম্প্রদায়। ঋণে জামিন হিসেবে সম্পত্তি না রাখতে পারলে বউ, বোন বাঁধা রাখতে হত ঋণদাতার কাছে। এই মহিলাদের শ্রমের সঙ্গে দেহ দিতে হত। এরপর ঋণ শোঢ না হলে ঋঙরহীতাকে দাস থেকতে হত ঋণদাতার কাছে। দারিদ্র্য ও দাসত্বের এই যন্ত্রণা ও দুঃখছিল ভয়ংকর। শ্রমজীবী শূদ্রদের জীবনও ছিল বিভীষিকাময়। দিন থেকে রাত কঠোর শ্রমের বিনিময়ে এক বেলা উচ্ছিষ্ট খাবার মিলত। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতে যাদের শূদ্র বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, বৌদ্ধ গ্রন্থে তারাই চণ্ডাল, নেসাদ, পুক্কুস নামে পরিচিত। পরিচয় পাল্টালেও ধনী মহাজনদের উৎপীড়ণ একই রইল।


শোষক-শাসক বা রাষ্ট্র গ্রাম থেকে সম্পদ সংগ্রহ করত চার ভাবে। ১. উৎপন্ন ফসলের উপর কর, ২. বাধ্যতামূলক শ্রম, ৩. রাজার জন্য ফসলের অংশ সংগ্রহ ও ৪. রাজাকে দেয়া আবশ্যিক কর। এই কর আদায় ছিল নিষ্ঠুর অত্যাচারমূলক। শারীরিক নির্যাতন, সম্পত্তি লুণ্ঠন, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, নারীদের উপর অত্যাচার- কী না হত! এই অত্যাচারের শিকার শুধু গ্রামের কৃষকেরা হত না, অন্যান্য বৃত্তিজীবী যেমন কট্টক (ছুতোর), কর্মার (কামার), মোদক (মাটি কাটার শ্রমিক), কুম্ভকার (কুমোর), রজ্জুবর্তক (দড়ি শ্রমিক) -রাও উৎপীড়িত হত। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মত মহাজনদের ঋণের বোঝা তো ছিলই। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পাচ্ছি, মৌর্য সাম্রাজ্যে সুদের হার ছিল শতকরা বার্ষিক ২৪০ মুদ্রা। পরে তা অর্ধেক করা হয়েছিল।


এই সামাজিক পরিস্থিতিতে দেখা যেত, কোন ঋণগ্রহিতা যদি বুঝতে পারতো, তার পক্ষে ঋণ শোধ করা অসম্ভব, তখন ক্রীতসাস জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে যেত। এর ফলে শ্রেষ্ঠী ও মহাজনদের মধ্যে বুদ্ধের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমে ওঠে। অবস্থা সামাল দিতে বুদ্ধ ঘোষণা করেন, 'ঋণী ব্যক্তিকে প্রবজ্যা (ভিক্ষু হতে দীক্ষা) দেয়া অনুচিত।' (মহাবগ্‌গ ১৩/৪/৮ ও বিনয়পিটক)


ক্রীতদাসরা তাদের দাসত্ব জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা এড়াতে ভিক্ষু হতে শুরু করেন। দাস মালিকরা বুদ্ধের উপর ক্রুদ্ধ হলেন। দাস-মালিকদেররাগ থামাতে বুদ্ধ আবার ঘোষণা করলেন, 'ক্রীতদাসদের জন্য প্রবজ্যা অনুচিত।' (মহাবগ্‌গ ১/৩/৪/৯) জেনে রাখা ভাল, বৌদ্ধ সংঘে ক্রীতদাসেরা শ্রম বিনিময় করত খাবারের বিনিময়ে।

মগধ সম্রাট বিম্বিসারের বহু সেনা যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে বৌদ্ধ ভিক্ষু হতে শুরু করে। বিম্বিসারের রাজশক্তি সেনানির্ভর। সুতরাং বুদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুগামী বিম্বিসারের বুদ্ধের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা আর রইল না। তিনি রাজসভায় মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শের পর ঘোষণা করলেন, সেনাদের ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষা দিলে বৌদ্ধগণ বা সঙ্ঘ অবিলম্বে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হবে। বৌদ্ধ ধর্মগুরুর শিরোচ্ছেদ করা হবে। বিম্বিসারের ক্রোধ থেকে বাঁচতে ও সংঘকে বাঁচাতে বুদ্ধ আর এক দফা ঘোষণায় জানালেন, 'রাজসৈনিকদের প্রবজ্যা অনুচিত।' (মহাবগ্‌গ ১/৩/৪/২, বিনয়পিটক)


শ্রেণীগতভাবে বুদ্ধ গোষ্ঠীপতি ধনী পরিবারের সন্তান। সে'ভাবেই বড় হয়েছেন। গরীবদের বাস্তব জীবনের চরম দারিদ্র্য ও দুঃখের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। দুঃখকে তিনি অনুভব করেছিলেন বৃদ্ধ, অসুস্থতা ও মৃত্যু দেখে। এই দেখে তিনি মানসিক আঘাত পেয়েছেন। দুঃখের কারণ খুঁজতে গিয়ে তিনি তৃষ্ণা ও অবিদ্যাকে দায়ী করেছেন। এ সবই পুরোন কথা। দুঃখকে জয় করতে কিছু শীল বা নীতি পালনের উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু যে কথা গভীরভাবে বলা দরকার, সেটা বোধ হয় নাবলাই থেকে গেছে।


শ্রমজীবী বা ক্রীতদাস পরিবারে জন্মালে বুদ্ধ উচ্চবর্ণের শোষণ ও অত্যাচার প্রতিটি দিক অনুভব করতে পারতেন। অত্যাচারের কারণগুলো, দুঃখের কারঙুলো তাঁর কাছে ধরা পড়েছে। কিন্তু তদকালীন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু করার বা বলার মত কোন বাস্তব অবস্থা ছিল না। শোষক-শাসক-রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করার চিন্তা ছিল আত্মহননের নামান্তর। ফলে তাঁকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপস করতে হয়েছিল।


বুদ্ধের যুগেই বণিকশ্রেণী জাতে ওঠে। তাদের রমরমা বাড়ে। বৈদিক যুগে বা ব্রাহ্মণদের বোলবোলাওয়ের যুগে বণিক বা শ্রেষ্ঠী শ্রেণীকে 'বৈশ্য' বলা হত। তারা ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। বুদ্ধ এই উঠে আসা নতুন শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে যে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে 'বুদ্ধ সুত্তনিপাত' গ্রন্থে। গ্রন্থটিতে একটি নিষেধের তালিকা আছে। এই তালিকা অনুসারে দেখা যাচ্ছে, ক্রীতদাস প্রথা, সুদ আদায়ের নামে ক্রীতদাস তৈরির ফাঁদ, বণীকশ্রেণীর চিত্ত বিনোদনের জন্য গণিকাবৃত্তি নিন্দিত হয় নি। বণিক সমাজের স্বার্থেই নিন্দিত হয় নি, বরং ঋণ শোধ না করা, দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে পালিয়ে যাওয়াকে অন্যায় ঘোষণা করা হয়েছে। বুদ্ধের পশু হতায়র বিরোধিতা বণিকশ্রেণীর স্বার্থকেই রক্ষা করেছিল, কারণ ওই সময় সম্পদ হিসেবে পশুকে গণ্য করা হত।


সব মিলিয়ে বৌদ্ধ ধর্মকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক, বণিক-মহাজন, রাজশক্তি তাদের সহায়ক শক্ত্রি বলে মনে করেছিল। ফলে শ্রেষ্টী থেকে সম্রাট প্রত্যেকেই উদার হাতে স্বর্ণমুদ্রার ঢের লাগিয়ে দিয়েছিল, উদ্যান দিয়েছিল, সংঘ তৈরি করে দিয়েছিল, উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিল প্রচুর ক্রীতদাস। বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে পড়েছিল রাজধর্ম, উচ্ছবর্ণের ও উচ্চবিত্তের ধর্ম। যদিও একথা ঠিক, শোষিত শূদ্ররাও বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করে ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিল।

উচ্চবর্ণের ভারতীয় দার্শনিক ও ঐতিহাসিকরা বুদ্ধকে উপজাতীয় থেকে ক্ষত্রিয় বানিয়ে ছেড়েছেন। শুদ্ধোধনকে বানালেন রাজা। অছচ বুদ্ধের সময়কার ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছে বুদ্ধ ছিলেন নীচবংশীয় মানুষ।


বিভিন্ন গ্রন্থে বুদ্ধকে 'বৃষল' বা 'নীচজাতীয়' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজা থেকে বণিকরা যখন বুদ্ধকে ধর্মগুরু হিসেবে গ্রহণ করল, তখন তাদের আত্মসম্মানের স্বার্থে বুদ্ধকে রাজা বলে ঘোষণা করেন। পরের পর্যায়ে তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার, তারপর ভগবানেরও ভগবান বানানো হল। নিরীশ্বরবাদী বুদ্ধ ঈশ্বর হয়ে গেলেন। আমরা ব্রাহ্মণ্যবাদী দার্শনিকদের কাছে ততটাই জানলাম, যতটা তারা জানালেন আমাদের বুদ্ধু বানাতে।

সময় বিশ্লেষণ এড়িয়ে বুদ্ধের শ্রেণীচরিত্র বিশ্লেষণ করলে তা হবে অবাস্তব, অসার। কোন সময়ে বুদ্ধ এসেছিলেন? একটু ফিরে দেখা যাক। সে সময় রাজশক্তি ছিল ভয়ংকর নিষ্ঠূর, উশৃঙ্খল, খামখেয়ালী চেহারার। কোশল রাজশক্তি বুদ্ধের চোখের সামনেই তাঁর জাতিগোষ্ঠী শাক্যদের নির্বিশেষে হত্যা করেছে। শিশু-নারী-বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায় নি।


বুদ্ধের চোখের সামনেই মগধরাজ অজাতশত্রুর আক্রমণে বিদেহ, জ্ঞাতৃক, লিচ্ছবি ও বৃজি উপজাতিরা ধ্বংস হয়ে গেল। বৃজি সাধারণতন্ত্রের সভাপতি চেটক (মহাবীর জৈন-এর মামা) পরাজিত হয়ে আত্মহত্যা করলেন। হত্যা তখন বীরত্বের প্রতীক। পরাজিত রাজ্যে লুণ্ঠন ও ধর্ষণ ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। তখন পাপ-পুণ্য, উচিত-অনুচিত বিচার করা বা এই বিষয়ে কিছু বলা পাগলামো ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন এক ভয়ংকর, ভয়াবহ সময়ে গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর জৈনের আবির্ভাব। সেই সময়কার হত্যা, রক্তপাত, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের ব্যাপকতায় অনেক চিন্তাবিদ হতবুদ্ধি ও বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। জৈন চিন্তাবিদ গোশাল মংখলিপুত্ত এত বর্বর হিংস্রতা দেখে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। সমসাময়িক চিন্তানায়ক ও ধর্মগুরু পূরণ কস্‌সপ, পকুধ কচ্চায়ন, অজিত কেশকলম্বী, সঞ্জয় বেলট্‌ঠিপুত্ত সে সময়কার রক্তক্ষয়ী অবস্থা দেখে নিরাশ হয়েছিলেন। তাঁদের মনে হয়েছিল, সমাজে ন্যায়বোধ ও অহিংসার প্রতিষ্ঠা, লোভের অবসান ঘটানো বাস্তবে সাধ্যাতীত। রাজশক্তির অনিবার্য লোভ, ক্রোধ, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, ভোগতৃষ্ণা রোধ করা অসম্ভব। মহাশক্তিধর, খামখেয়ালি রাজশক্তির বিরুদ্ধে কথা বলার অর্থ নিজের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করা।


এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে বুদ্ধের পক্ষে রাষ্ট্রষক্তির বিরোধিতা করার অর্থ অনিবার্য মৃত্যুকে ডেকে আনা। তাই তিনি রাজশক্তির রোষ থেকে বাঁচতে ঋণগ্রহীতা দাস ও সেনাদের ভিক্ষু করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। চেতনার ও যুক্তিবাদের বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন যে মানুষটি, তাঁর বেঁচে থাকাটা সংস্কৃতির প্রগতির জন্যেই অত্যন্ত জরুরি ছিল। অতি-বিপ্লবীপনা দেখাতে গিয়ে তিনি যে কোন হঠকারি সিদ্ধান্ত নেননি, রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে প্রয়োজনীয় আপস করে কৌশল্গত ভাবে ঠিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন- এ বিষয়ে সন্দেহর কোনও অবকাশ নেই।


বৌদ্ধ যুগে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চারুকলা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, যৌনবিজ্ঞান সহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিশাল রকমের উন্নতি ঘটিয়েছিল। এই উন্নতির মান এতটাই ক্লাসিকাল বা চিরায়ত ছিল যে, পরবর্তী সময়ে সুদীর্ঘ কাল ধরে তা আদর্শ ও অনুসরণযোগ্য বলে গৃহীত হয়েছিল। চরক, সুশ্রুত, নাগার্যুন, ভাস্করাচার্য, বাৎসায়ন, কৌটিল্য, পাণিনি, অশ্বঘোষ প্রমুখ মননশীল পণ্ডিতরা ছিলেন বৌদ্ধ বা বৌদ্ধভাবাশ্রয়ী। বৌদ্ধ যুগে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল।


বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি গ্রীক, কুষাণ, শক রাজাদের সমর্থন :

বৌদ্ধ ধর্ম বিভিন্ন রাজাদের সমর্থন ও আর্থিক সাহায্য পেয়েছিল। এমন সাহায্য পাওয়ার জন্য কেউ কেউ বৌদ্ধধর্মকে 'প্রতিক্রিয়াশীল ধর্ম', 'রাজশক্তির ধর্ম' বলে চিহ্নিত করে থাকেন। সত্যি এটা একটা জরুরি প্রশ্ন- কেন গ্রিক, কুষাণ, শক রাজার বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন?



হিন্দুধর্মে ধর্মান্তর ছিল অত্যন্ত কঠিন। সাধারণত জন্মগতভাবেই একজন হিন্দু হয়। হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রথা এতটাই প্রবল ছিল যে, বর্ণপ্রথা বাদ দিয়ে হন্দু ধর্মকে ভাবাই যেত না। কোন পুরুষ নিচু বর্ণের কোন নারীকে বিয়ে করলেই নারী উঁচু বর্ণে স্থান পেত না। এমনকী, তার সন্তান্রাও মনুর ধর্মীয় আইন অনুসারে বহুভাবে বঞ্চিত হত। স্ত্রী রক্ষিতার বেশি মর্যাদা পেত না।


বিদেশ থেকে যেসব রাজারা এদেশে প্রবেশ করেছিলেন তাদের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল এদেশেরই একজন হবার। এদেশের মেয়েদের বিয়ে করে ঘর বসাবার। হিন্দুধর্মের ছড়ি যাদের হাতে, তাদের একটা সমস্যা ছিল। এইসব বিদেশি রাজা আর তাদের সেনাদের কোন বর্ণের খোপে ঢোকাবে? কারণ বর্ণ তো জন্মগত ব্যাপার!

ভারতবর্ষে তখন বৌদ্ধ ধর্ম রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম হল উদার। জাত-পাত-বর্ণ নেই। সবাইকে গ্রহণ করতে হাত বাড়িয়েই আছে। এই অবস্থায় বিদেশ থেকে আগত রাজশক্তি বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করাকেই সম্মানজনক মনে করেছিলেন। এই কারণেই গ্রিক, শক, কুশান প্রভৃতি রাজশক্তি ও তাদের সঙ্গে আসা সৈন্য-সামন্ত বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই বৌদ্ধ ধর্ম রাজশক্তির সহযোগিতায় তুঙ্গে উঠেছিল।


বিদেশি রাজারা বৌদ্ধধর্মকে সমস্ত রকমভাবে সাহাহ্য করছেন দেখে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের গোঁড়ামি কিছুটা কমালো। বা বলতে পারি বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ঠেকাতে কিছুটা কৌশল গ্রহণ করল। তারা গ্রিক, শক, কুষাণদের 'পতিত ক্ষত্রিয়' বলে আখ্যা দিল। এতে দুটি ঘটনা ঘটল। ১. ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বর্ণপ্রথা বড় ধরণের ধাক্কা খেল। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের একটা বড় অংশই বর্ণের নতুন সমীকরণ মেনে নিল না। ২. সমাজের বহু নিচু বর্ণের মানুষ বিদেশিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে সমাজের দু-এক ধাপ উপরে উঠতে চেষ্টা করল।


এরপর একটা প্রশ্ন উঠে আস্তেই পারে, অশোক তো বিদেশি ছিলেন না, তিনি কেন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন? অশোক তাঁর রাজত্বকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। এই বিস্তৃতির পেছনে সামরিক শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়েছে। যুদ্ধ, হত্যা, লুণ্ঠন, রক্তপাত ইত্যাদি দেখে এক সময় হিংসার প্রতি তাঁর বিরাগ জন্মেছিল। তারই পরিণতিতে অশোক অহিংস বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সাম্রাজ্য জুড়ে বহু ধর্মলিপি খোদিত করিয়েছিলেন।


বৌদ্ধদের 'বৌদ্ধ সঙ্গীতি' বা মহাসম্মেলন

অশোক,কুষাণ সম্রাট কনিষ্ক বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি এতটাই জরিয়ে পড়েছিলেন যে, বৌদ্ধ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। বুদ্ধের মৃত্যুর অল্প কিছুকালের মধ্যে রাজগৃহে প্রথম 'বৌদ্ধ সঙ্গীতি' বা মহাসম্মেলন হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাস্মমেলন হয়েছিল বৈশালীতে বুদ্ধের মৃত্যুর একশো বছর পরে। এই সম্মেলনে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দশটি কাজকে সংঘবিরোধী বলে ঘোষণা করেন বুদ্ধপন্থীরা। তখন আর একটি পৃথক মহাসম্মেলন করে নব্যপন্থী দশটি বিষয়কেই নিয়মসিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। তারা নিজেদের 'মহাসংঘিক' ও প্রাচীনপন্থীদের 'স্থবিরবাদী' বলে পরিচয় দেন। এই মহাসংঘিক্রাই পরবর্তীতে মহাযানপন্থী ও স্থবিরবাদীরা হীনযানপন্থীতে রূপান্তরিত হন।


সম্রাট অশোকের পৃষ্টপোষকতায় পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলন হয়েছিল। এটা ছিল স্থবিরবাদীদের সম্মেলন। এই সম্মেলনে ন্য মাস পরিশ্রমে স্থবিরপন্থী বোউদ্ধ পণ্ডিতরা 'স্থবিরবাদী ত্রিপিটক' রচনা করেন। এরপর অশোক দেশ-বিদেশে বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারক পাঠান। যেসব অঞ্চলে প্রচারক্রা গিয়েছিলেন সেসব অঞ্চলে হীনযানপন্থীরাই প্রবল।


চতুর্থ বৌদ্ধ মহাসম্মেলন হয়েছিল কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীরে অথবা জলন্ধরে। সম্মেলনে স্থবিরপন্থীদের ও মহাসংঘিকদের বিভাজন স্পষ্ট রূপ পেল। এটা ছিল খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের ঘটনা। নাগার্জুন মহাযানপন্থীদের নির্দিষ্ট রূপ দেন। পরবর্তীতে মহাযানপন্থীরা নিজেদের মত করে ত্রিপিটকে কিছু কিছু বিকৃতি ঘটাল। মহাযান থেকেই তান্ত্রিক-বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব।


তথ্যসূত্র :

১. ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস - নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

২. বৌদ্ধ দর্শন - রাহুল সাংকৃত্যায়ন

৩. অলৌকিক নয় লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড) - প্রবীর ঘোষ