স্বামী বিবেকানন্দের অনেক সুন্দর সুন্দর বাণী আছে। যেমনঃ
১. জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
২. হে ভারত ভুলিও না মেথর মুচি চণ্ডাল তোমার ভাই...
৩. খালি পেটে ধর্ম হয় না...
৪. ভারত বেরুক চাষার কুটির ভেদ করে......
এমনই আরও অনেক হাজার বাণী হাজির করা যায়, যেগুলো সত্যিই শুনতে ভাল লাগে। বিবেকানন্দকে খণ্ডিতভাবে না জেনে সামগ্রিকভাবে জানতে তাঁর 'বাণী ও রচনা', 'পত্রাবলী', নিবেদিতার লেখা 'স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি', শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখা 'বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ' নামক বইগুলো পড়াটা জরুরি। এসব পড়লে বিবেকানন্দ সম্পর্কে যে ধারণা পরিষ্কার হয়ে ওঠে তা ভয়ংকর! সোজা-সাপটা স্ববিরোধীতা।
বিবেকানন্দ এক দিকে বাণী দিচ্ছেন "জীবে প্রেম করে যেই জন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর" পাশাপাশি কলকাতার বরানগরের মাঠে পশুবলির প্রবর্তন করেন।
দরিদ্র সেবার খেত্রেও ছিলেন পাকা হিসেবি। ১৮৯৭ সালে বিবেকানন্দ একটি চিঠি দিয়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে নির্দেশ দেন, "কলকাতার মিটিং-এর খরচা বাদ দিয়ে যা বাঁচে ঐ famine-এতে (দুর্ভিক্ষে) পাঠাও বা কলকাতা, ডোমপাড়া, হাড়িপাড়া বা গলিঘুঁজিতে অনেক গরীব আছে তাদের সাহাহ্য কর... তারপর লোকের (হিন্দুত্বে) বিশ্বাস হবে, তারপর যা বলবে শুনবে।" (পত্রাবলি, পত্র নম্বর ৩৬৩)
বিবেকানন্দ একদিকে বলেছেন, " হে ভারত ভুলিও না মেথর মুচি চণ্ডাল তোমার ভাই...", বলেছেন, "ভারত বেরুক চাষার কুটির ভেদ করে...", তখন তিনিই চিঠি লিখে শিষ্যদের নির্দেশ পাঠাচ্ছেন, " ধনী দরিদ্রের বিবাদ যেন বাঁধিয়ে বসো না। ধনীদের আদতে গালমন্দ দেবে না।" (পত্রাবলী, পত্র নম্বর ৪৭৬)
'ব্রহ্ম-বাদিন্' পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে কী করা উচিৎ, সে বিষয়ে উপদেশ দিয়ে তাঁর একটি চিঠি, " গত সংখ্যায় ক্ষত্রিয়দের খুব বাড়ান হয়েছে, পরের সংখ্যায় ব্রাহ্মণদের খুব প্রশংসা কর, তারপরের সংখ্যায় বৈশ্যদের।" (পত্রাবলী, পত্র নম্বর ২৩৯)
বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর ও রামমোহনের মতামত জানি। বিবেকানন্দ এই প্রসঙ্গে বলেছেন, " বাল্যবিবাহের উপর আমার প্রবল ঘৃণা।" (ভারতীয় নারী, প্রকাশক উদ্বোধন কার্যালয়, পৃষ্ঠা ৯০)। তারপরই আমরা ভয়ংকর রকমের ধাক্কা খাই, যখন দেখি "ভারতীয় নারী' বইটির ১৫ পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দের একটি মত মুদ্রিত রয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, "কখনো কখনো শিশু বয়সেই আমাদিগকে বিবাহ দেওয়া হয়, কেন না বর্ণের নির্দেশ। মতামতের অপেক্ষা না রাখিয়া যদি বিবাহের ব্যবস্থা করিতে হয়, তবে প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হওয়ার পূর্বে বিবাহ বাল্যকালে বিবাহ দেওয়া ভাল।"
প্রণয়বৃত্তি বা প্রেম সম্বন্ধে বিবেকানন্দের মতামতে চোখ রাখি আসুন। তিনি বলেছেন, "যদি কাউকে ইচ্ছেমতো পতি বা পত্নীরূপে গ্রহণের স্বাধীনতা দেওয়া যায়, যদি ব্যক্তিগত সুখ এবং পাশবপ্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির চেষ্টা সমাজে বিস্তার লাভ করে, তার ফল নিষচয় অশুভ হবে- দুষ্টপ্রকৃতি, অসুর ভাবের সন্তান জন্মাবে।" (বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, ৩য় খণ্ড, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, পৃষ্ঠা ২৬৪)।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ অনেক দেশপ্রেমীর কাছে বিবেকানন্দ ছিলেন আদর্শ। ১৮৯৭-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি কল্কাতা-অভিনন্দনের উত্তর দিতে গিয়ে বিবেকানন্দ আবেগের সঙ্গে বলেছিলেন, "ইংরাজদের সম্বন্ধে যে ঘৃণার হৃদয় নিয়ে আমি ইংলণ্ডের মাটিতে পদার্পন করেছিলাম, কোন জাতি সম্বন্ধে তার থেকে অধিক ঘৃনার ভাব নয়ে সে দেশের মাটিতে আর কেউ কখনো নামেনি।" বিবেকানন্দের এই বক্তব্যকে অনেকেই তুলে ধরে প্রমাণ করতে চান তার ইংরেজ-বিদ্বেষ। কিন্তু আসলে এটা বিবেকানন্দের বক্তব্যের অংশ বিশেষ। "কেউ কখনো নামেনি"-র পরের লাইনেই বিবেকানন্দ বলেছিলেন, " এই সভামঞ্চে যেসব ইংরেজ বন্ধু উপস্থিত আছেন, তারাই সে বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন। কিন্তু যতই আমি তাদের মধ্যে বাস করতে লাগলাম, তাদের জাতীয় জীবনযন্ত্র কিভাবে কাজ করছে দেখতে পেলাম, তাদের সঙ্গে মিশে জানলাম কোথায় রয়েছে তাদের জাতির হৃৎস্পন্দন - ততই আমি তাদের ভালবাসতে লাগলাম। তার ফলে, হে ভাতৃগন, এখানে এমন কেউ নেই যিনি আমার থেকে ইংরাজদের বেশি ভালবাসেন।" (বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২)। বিবেকানন্দের 'বাণি ও রচনা' ৯ম খণ্ডের ২৫৩ পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দ বলেছেন,"সকল কথার ধুয়ো হচ্ছে - 'ইংরেজ আমাদের দাও।' বাপু আর কত দেবে? রেল দিয়েছে, তারের খবর দিয়েছে, রাজ্যে শৃংখলা দিয়েছে, ডাকাতদের তাড়িয়েছে, বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে। আবার কী দেবে? নিঃস্বার্থভাবে কে কী দেয়? বলি তোরা কী দিয়েছিস?"
বিবেকানন্দের এই সব বক্তব্য তুলে বলতে চাইছি, বিবেকানন্দকে পুরোপুরি ইংরেজ বিদ্বেষী বলে বর্তমানে যেভাবে চিত্রিত করা হয়, সেটা ঠিকা নয়। তিনি তাঁর স্বভাব বৈশিষ্ট্য অনুসারে কখনো ইংরাজ-প্রেম, কখনো ইংরেজ-বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন।
বিবেকানন্দের কিছু ভাল বাণী পড়ে খণ্ডিত বিবেকানন্দকে না জেনে সম্পূর্ণ বিবেকানন্দকে জানতে আন্তরিকতার সঙ্গে বইপত্র আদ্যন্ত পড়ুন। দেখতে পাবেন, বিবেকানন্দের সতীদাহের প্রতি সমর্থন থেকে বিধবা বিবাহ বিরোধিতার সম্পূর্ণ চিত্র। দেখতে পাবেন বিবেকানন্দের স্ববিরোধিতার নানা দিক। সুতরাং তাঁর প্রগতিশীল বাণিগুলোই শেষ কথা নয়।
বিদ্যাসাগর, রামমোহন শিক্ষা প্রসারে সমাজ সংস্কারে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। শিক্ষা বিষয়ে বিবেকানন্দের মত ছিল একটু ভিন্ন রকম। তার কথায়, " এইসব বই, এইসব বিজ্ঞান আমাদিগকে কিছুই শিখাইতে পারিবে না। বই পড়িয়া আমরা তোতাপাখি হই, বই পড়িয়া কেহ পণ্ডিত হয় না। ... বই যত কম পড়েন ততই ভাল। ... গ্রন্থ দ্বারা জগতের ভাল অপেক্ষা মন্দ অধিক হইয়াছে।" (বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৫,৯৯ এবং ১০৯) সমাজ সংস্কার সম্বন্ধে বিবেকানন্দের স্পষ্ট অভিমত, "সমাজ সংস্কার ধর্মের কাজ নয়।" (পত্রাবলী, পত্র নম্বর ৮৩)
যে মতামত, আদর্শ ও আন্দোলনের জন্য বিদ্যাসাগর, রামমোহনকে আমরা শ্রদ্ধা করি, সেই মতামতের, আদর্শের বিরোধী চরিত্র'কে আমরা শ্রদ্ধা জানাবো কী করে? এতে আমাদের স্ববিরোধিতা, ভণ্ডামী, অজ্ঞতাই কি প্রকাশিত হয় না?
আমরা কী করবো, আমাদেরই ঠিক করতে হবে। আমজনতার আবেগে গা ভাসাবো, না-কি যুক্তি-বুদ্ধিকে শানিত করতে সচেষ্ট হবো? আবেগ হল যুক্তির সবচেয়ে বড় শত্রু। আবেগ চিন্তা শক্তিকে দুর্বল করে, যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা শেষ করে দেয়। চিন্তা একটা অভ্যাস, একটা চর্চা। এই চর্চা ও শৃংখলাবদ্ধ যুক্তির মধ্য দিয়ে এগোলে সব সময়-ই আমরা উন্নত থেকে উন্নতত্তর মূল্যবোধে পৌঁছতে পারবো। বুঝে নিতে পারবোকোনটা ভালো, কোনটা খারাপ; কোনটা কালো, কোনটা সাদা। তারপরও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কালোকে কালো, আর সাদাকে সাদা বলার হিম্মত দেখাবো কি না? একটা লাগাতার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ভীরুও সাহসী হয়ে ওঠে; সাহসী হয় ভীরু। মানষিকভাবে সাহসীদের সঙ্গে গভীর মেলামেশার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ভীরুও সাহসী হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়াকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে 'গ্রুপ থেরাপি'। আবার একজন শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষও জেলের প্রহার ও অন্ধকার সেলে থাকতে থাকতে একসময় সাধারণ আলো দেখলেও ভয় পেতে পারে। পাশা-পাশি এও সত্যি- একজন ব্যক্তির আদর্শ, সাহস বহুজঙ্কে উদ্দীপ্ত করে। আপ্নি-আমিও পারি সেই ব্যতিক্রমী মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে।
হ্যাঁ, আমাদেরই ঠিক করতে হবে,জনতার আবেগের সুরে সুর মেলাবার নিরাপদ পন্থা গ্রহন করবো, নাকি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার হিম্মত দেখাবো? আমরা কাকে শ্রদ্ধা জানাবো- যাঁদের কর্মময় জীবন-ই ছিল বাণী, না-কি বাণীদান-ই যাঁদের প্রধান কর্ম?
আমি লেখাটি গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠ করে লেখকের সিদ্ধান্তেই সহমত জানাই। এটা সত্য স্বামী বিবেকানন্দ নিয়ে একটা মীথ গড়ে উঠেছে অবিরাম খন্ডিত লেখা সমূহ প্রচারের ফলে
উত্তরমুছুন